চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি সময়ের দাবি

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২১, ১৫:১৬

রবিউন নাহার তমা

সিমিন সদ্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জয়েন করেছেন। চাকরির বয়স শেষ হয়ে গিয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। এগারো দিনের জন্য ৪৩ তম বিসিএসে আবেদন করতে পারেননি। জানুয়ারি মাসে এনএসআই এর একটি সার্কুলার হাতছাড়া হয়েছে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে। অথচ সব ঠিক থাকলে এ সার্কুলারগুলো হয়ে যাওয়ার কথা নভেম্বরের আগেই। চাকরির জন্য চার-পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করেছেন, ভাইভাও দিয়েছেন বেশ কয়েক জায়গায়-কিন্তু ভাগ্যের শিকে শেষ পর্যন্ত ছেড়েনি। অবশেষে একরকম নামমাত্র বেতনে যোগ দিয়েছেন এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

দুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে সে জানায় এই করোনায় তাদের প্রতিষ্ঠানে শ-খানেক লোক ছাঁটাই হয়েছে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে সিমিনের কপালে। সিমিন তাও ভাগ্যবান যে, এই দুঃসময়ে একটি চাকরি জুটিয়েছেন, কিন্তু অনেকে তাও পারেননি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেহেদী জানান সেরকম কথাই। দীর্ঘশ্বাস  ফেলে বলেন-একটা চাকরি হলে বড় বাঁচা বেচে যেতাম! তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এত বছর চাকরির চেষ্টা না করে উদ্যোক্তা কেন হলেন না?  নিজের প্রতিষ্ঠানে বরং অন্যকে চাকরি দিতে পারতেন। একরকম হেসেই বললেন-দেখুন, উদ্যোক্তা হওয়াও কিন্তু এত সহজ নয়। প্রতিদিন দেশে শত শত মানুষ উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু বছর শেষে কজন সফল হতে পারছেন? চাকরি খোঁজা বরং এর চেয়ে সহজ ও নিরাপদ।

আমাদের দেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেয়ার মানুষ কমই পাবেন। তাছাড়া আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রতি সমাজের কথা বাদ দিলাম, অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা পাল্টেছে? একজন নারী বাসায় সেলাই করে, কেক বানিয়ে বা রান্না করে মাসে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা আয় করলে তাকে নিয়ে টেলিভিশন-পত্রিকায় খবর চলে যায়,বাসায়ও তার সম্মান বেড়ে যায়। আর পুরুষ মানুষ মুরগির খামার দিলে তাকে "মুরগিওয়ালা"বলা হয়। মিথ্যা সামাজিক মর্যাদার বলি হয়েও অনেক শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা হতে চান না। ক্লাস থ্রি-ফোরে ভালো রেজাল্ট করলেই অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আজকাল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সেখানে শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ কিন্তু ততটা মসৃণ নয়।

 

দুশ্চিন্তার ভাঁজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষের শিক্ষার্থীদের কপালেও। কোথায় প্রথম বর্ষে এসে জীবনের উজ্জ্বল এক অধ্যায় শুরু করবেন, নতুন চোখে পৃথিবীটা দেখবেন তা নয়-এই মহামারি যেন জীবনের নতুন মোড় দেখার চোখে ছানি ফেলে দিয়েছে। প্রায় দুই বছর হয়ে গেলেও প্রথম বর্ষ শেষ না হওয়াতে চাকরির জন্য ন্যুনতম যোগ্যতা স্নাতক শেষ করার পর তাদের চাকরিতে আবেদনের বয়স আর কত বছর থাকবে তা ইতোমধ্যেই তাদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দাবি-যাদের বয়স আটাশ-উনত্রিশ হয়ে গেছে শুধু তাদের জন্যই নয়,বরং সব শিক্ষার্থীর স্বার্থে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ন্যুনতম ৩২ করা উচিত।

 

বাজারের এক আলু ব্যবসায়ীতো ছেলের কথা বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। তার ছেলে শফিউল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ছাত্র। তৃতীয় বর্ষে এসে দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার দেড় বছরের মতো সময় নষ্ট হয়েছে। অথচ এতদিনে তার স্নাতক শেষ হয়ে স্নাতকোত্তরের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা! ছেলের পড়াশোনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন- "আমরা তো বাবা গরীব মানুষ,অতশত বুঝিনা। ছেলে পড়ালেখার জন্য বাসায় রাউটার না কি যেন লাগাইছে, মোবাইল নিয়া বইসাও থাকে। কিন্তু তারপরেও বুঝি ক্লাস-পড়ালেখা কিছুই ঠিকঠাক কিছুই হইতেছে না।" বলতে বলতে চোখ মোছেন তিনি।

 

সেশনজট না থাকায় হিসাব অনুযায়ী তেইশ-চব্বিশ বছরের মধ্যেই একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নানারকম জটিলতায় পড়ে সেটা পঁচিশ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে চাকরি খোঁজার জন্য হাতে সময় থাকে মাত্র পাঁচ বছর। অথচ উন্নত বিশ্বসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চাকরি খোঁজার জন্য দশ বছরেরও বেশি সময় হাতে থাকে।

 

দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক ও গবেষকদের মতানুযায়ী তরুণদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই চাকরির প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। তরুণদের ১৫ কিংবা ১৮ বছরের পর কর্মে যুক্ত হতে হবে। তাদের মূলমন্ত্র হবে কর্মে যুক্ত হতে চাওয়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চাকরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অনেক মেধা হারিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। লাইব্রেরিতে জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে হচ্ছে MP3 কিংবা জব সলিউশন মুখস্থ করার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আশংকাজনক ব্যাপার হলো যারা প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষ থেকে চাকরির পড়া মুখস্থ করছে তাদের চেয়ে বরং অনার্স বা মাস্টার্স ভালোভাবে শেষ করা একজন শিক্ষার্থী মাত্র ছয়-সাত মাস পড়াশুনা করেই ভালো চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন!

 

কারণ হিসেবে বলা যায় তাদের হাতে প্লান বি থাকে। তারা যেহেতু ভালো জিপিএ অর্জন করেছেন তাদের সামনে বিসিএস ক্যাডার কিংবা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি ছাড়াও গবেষক হওয়া,উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে যাওয়া কিংবা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত চাকরির ভালো সুযোগ থাকে, সুতরাং তারা বেশ রিলাক্সে পড়াশুনা করেন। অন্যদিকে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে চাকরির পড়াশুনা শুরু করা তরুণ একাডেমিক পড়াশুনায় যথেষ্ট সময় ব্যায় না করায় তার জিপিএ আশানুরূপ হয় না। প্লান বি না থাকায় অনার্স বা মাস্টার্সের পর তখন চাকরির পড়াশুনা তার কাছে একপ্রকার চাপ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত যদি তিনি প্রথমে দুএকটা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তাহলে হতাশা তাকে গ্রাস করে ফেলে।যা কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে চলা তার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়।

 

মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। আমাদের বিভাগে যে শিক্ষার্থী প্রতি বর্ষে প্রথম হতেন, তাকে পাঁচবছরে কোনদিন চাকরির পড়াশুনা করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই যাদের হাতে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা এজাতীয় কিছু বেশি দেখতাম তাদের সবাইকে টপকে তিনিই আজ বিসিএস প্রশাসনে কর্মরত! এমন উদাহরণ খুঁজলে আরোও অনেক পাওয়া যাবে।

 

আবার ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের পর কর্মে যুক্ত হওয়ার কথা বললে বলতে হয় আমাদের দেশ ইউরোপ আমেরিকা নয়। এ বয়সে আমাদের দেশে কর্ম করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা, সার্টিফিকেট কিংবা সুযোগ কোনটাই পাওয়া যায় না। এ বয়সের বহু তরুণকে বরং দোকানের কর্মচারী, টেম্পোর হেলপার কিংবা মেকানিক হিসেবে দেখা যায়। তারাও কর্মী, কিন্তু তাদের এই কর্ম দেশের জিডিপি বাড়াতে কতটুকু সহায়ক তা প্রশ্ন থেকে যায়।আসলে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, নানারকম জটিলতার কারণে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার আগেই একজন শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি আসলে চাকরি খোঁজার জন্য ঠিক কত বছর সময় পাচ্ছেন।

 

উদাহরণ হিসেবে বিসিএস পরীক্ষার কথাই ধরা যাক। গত ১৯শে মার্চ প্রায় সত্তর শতাংশ পরীক্ষার্থীর অনাগ্রহে এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধেরও বিপরীতে গিয়ে পিএসসি ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিয়েছে। প্রধান যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল যে চারটি বিসিএসের জট খোলা হবে। অথচ স্মরণকালের ইতিহাসে ৪১তম প্রিলিমিনারি রেজাল্টই বোধহয় সবচেয়ে দেরিতে হতে যাচ্ছে। প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেলেও বের হয়নি পরীক্ষার ফল। ৩৮ তম বিসিএসের নিয়োগ হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩ বছর চার মাসের মত সময়। তখন করোনা ছিল না। আর চলমান পরিস্থিতে ৪১ তম বিসিএসের নিয়োগ যে কত দ্রুত হবে তা সহজেই অনুমেয়! এ পরীক্ষার ফলাফলের ওপরে নির্ভর করছে হাজারো পরীক্ষার্থীর বহুদিনের স্বপ্ন-সাধনা। অথচ প্রতি বছর এ নিয়োগগুলো যথাসময়ে হলে নিয়োগপ্রাপ্তরা তাদের চাকরিতে প্রবেশ করতেন, আর যারা নিয়োগ পাননি তারা দ্রুতই অন্যদিকে নিজেদের কর্মস্থল বেঁছে নেয়ার সুযোগ পেতেন। বেঁচে যেতো লাখো শিক্ষার্থীর বহু মূল্যবান সময়। এ সময়টাকে কাজে লাগিয়ে বাড়ানো যেত দেশের উৎপাদন।

আবার চাকরি খোঁজার জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আদাজল খেয়ে চাকরির পড়াশুনা করতে হবে না। বরং তারা তুলনামুলক চাপমুক্ত থেকে একাডেমিক পড়াশুনায় মন দিতে পারবেন। তাতে জ্ঞান বাড়ার পাশাপাশি জিপিএও বাড়বে। এত করে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মের ক্ষেত্র বাড়বে। সুযোগ্য সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর পাশাপাশি দেশে গবেষক, ভালো উদ্যোক্তার পাশাপাশি দক্ষ কর্মীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। বেকারের সংখ্যাও কমবে। 

 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর আঞ্চলিক কর্মসংস্থান প্রতিবেদন-২০১৯ অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হারে ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আইএলও এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১২ সালে সরকারি চাকরিতে অবসরের সীমা ৫৭ থেকে ৫৯ করা হয়েছে, অথচ একই বছরেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করা যেত।

 

দুইবছর অবসরের সীমা বৃদ্ধি করাতে চাকরিজীবীরা সুফল ভোগ করছেন অথচ সেই দুই বছর শুন্যপদের সৃষ্টি না হওয়ায় বিপাকে পড়ছেন চাকরি প্রাথীরা। সহজ কথায় বললে অবসরসীমা বৃদ্ধির সুফল নয় বছর ধরে ভোগ করা শুরু করেছেন চাকরিজীবীরা কিন্তু গত নয় বছর ধরে আরও বিপাকে পড়েছেন চাকরি প্রার্থীরা। করোনা পরিস্থিতি এই অবস্থাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।জরিপ বলছে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ছিল ১১ শতাংশের সামান্য বেশি, ২০২১ সালে সেটা গিয়ে দাড়িয়েছে ২৬ শতাংশে! বেকারত্ত্বের হারও বেড়েছে আনুপাতিক হারে। হয়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে আশংকাজনকহারে যা চরম উদ্বেগের বিষয়।

 

দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় রেখে এই শিক্ষিত বেকার তরুণদের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে হতাশাগ্রস্থ এ তরুণ সমাজ জীবনের খেই হারিয়ে ফেলতে পারে।হতে পারে বিপথগামী। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে আবার চাকরির অপেক্ষায়ও বাড়তে পারে বেকারত্ত্ব,কমে যেতে পারে উদ্যোক্তার সংখ্যা এসব কিছু মাথায় রেখে তাই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ না করা গেলেও অন্তত ৩২ করাটা অতি জরুরি। যদি তা না করা হয়,তবে চাকরি প্রার্থীদের সাথে একরকম জুলুম করা হবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি তাই এখন সময়ের দাবি।

 লেখক: শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/৭জুন/এসকেএস