বাঁচতে হলে বুঝতে হবে ডিপ্রেশনকে

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২১, ১৬:৫৩ | আপডেট: ০৭ জুন ২০২১, ১৭:২৫

মুনমুন শারমিন শামস

আবার দুইটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরতাজা একটা তরুণ সুইসাইড করছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তার পারিবারিক সংকটগুলো তীব্র হয়ে উঠছিল, বলছে তার বন্ধুরা। মা মারা গেছেন, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে মানায়ে নিতে পারে নাই নিজেকে। ক্যাম্পাসে থাকলে নিজেকে বন্ধুদের মাঝে রাখলে ভুলে থাকতো। করোনার পরে বাড়ি গিয়ে থাকতে বাধ্য হলো। আর এরপরই ডিপ্রেশন, যা সব কিছুর ঊর্ধে নিয়ে গেছে তাকে।

আরেকটা ঘটনা খুবই অমানবিক। ৩৫ বছর বয়সী একজন আইটি ফ্রিল্যান্সার। করোনার পরে দেনার দায়ে জর্জরিত। হাতে কাজ নাই। দুটো সন্তান। বাড়িতে খাবার নাই গত তিন মাস। বউ কষ্টেসৃষ্টে খাবার যোগার করে। এসব থেকে মুক্তি পেতেই ‍সুইসাইড করছেন তিনি। তীব্র ডিপ্রেশন, হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন মৃত্যুতে। পিছনে রেখে গেছেন সন্তান আর স্ত্রীকে। 

দুইটা আত্মহত্যাই করোনাকেন্দ্রীক মানসিক আর্থিক সামাজিক পারিবারিক সংকট থেকে আসা তীব্র বিষন্নতার ফলে ঘটছে। এই বিষন্নতা যে সে বিষন্নতা না; একটু চা খেলুম কি ঘুমিয়ে থাকলুম, কি প্রেমে পড়লুম কি গান শুনলুম আর বেশ কেটে গেল, না, এমন না ব্যাপারগুলো। এই বিষন্নতা একটা কঠিন রোগ, একটা অস্তিত্ব সংকট, ব্যাধি, যন্ত্রণা যা মানুষকে শেষাব্দি নিজেকে শেষ করে দিতে বাধ্য করে। একে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহুদিন ধরে, মানে ধরেন গত ১০ বছর ধরে সতর্ক করে আসছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ বিষন্নতা নামের ব্যাধিটা মহামারি আকারে দেখা দেবে। পৃথিবীজুড়ে আর্থ-সামাজিক সংকটের বিরাট বড় কারণ হবে এই ডিপ্রেশন রোগ। করোনা ভাইরাস আসবার পর আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি কত দ্রুত গতিতে আমরা এই পরিস্থিতিটার দিকে আগায়ে যাচ্ছি।

আমার লিস্টে বহু তরুণ তরুণী আছে যারা প্রায়ই পোস্ট দেয় করোনার কারণে পরিবারের সাথে থাকতে হচ্ছে বলে কী কী সমস্যা তাদের হচ্ছে। অনেকে ইনবক্সে এসে আমার সাথে শেয়ারও করেছে। আমি নিজেই তো চোখের সামনে দেখতে পাই আমার ক্লাস টু পড়ুয়া ছোট্ট মেয়ে কীভাবে প্রতিদিন বিষন্নতা জয়ের যুদ্ধটা করে। আমিও করি। আমরা ভেতরে ভেতরে কীভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছি, নিজেরাও টের পাচ্ছি না। আর করোনা যাদের হয়েছে, তাদের স্নায়বিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার আশংকাও খুব বেশি। গবেষণা বলছে, পৃথিবীজুড়ে তিন জনে একজন কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর স্নায়বিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যা ছিড়ি, তাতে করোনা পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার কোনো রকম মাথা ঘামাবে না, ব্যবস্থা নেবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন। আশঙ্কা করি, ডিপ্রেশন বড় আকারে ছড়াবে। বহু ক্ষয় ক্ষতি হবে। অনেক বড় সংকটে পড়বো আমরা।

এই সংকট থেকে বাঁচব কীভাবে?

বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে। নিজেকেই। নিজের জন্য নিজেকেই জানতে হবে, বুঝতে হবে ডিপ্রেশনকে। মনে রাখবেন, এটা একটা ব্যাধি। এর চিকিৎসা দরকার। নিজের সিম্পটম বুঝে সাহায্য নিন পেশাদার চিকিৎসকের। থেরাপি নিন, কাউন্সিলিং নিন। প্রয়োজনে মেডিসিন নিন। কিন্তু নিজেকে আড়াল করে রাখবেন না। লজ্জা বা ভয় পাবেন না। মনে রাখবেন, আমরা সবাই কম-বেশি বিষন্নতায় ভুগি। নানা রকম ফোবিয়াতে ভুগি। নানা সংকট আছে আমাদের মনোজগতে, সবারই। তাই নিজেকে নিয়ে বিব্রত থাকার কোনো প্রয়োজন নাই। এটা অনর্থক। বরং নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। সাহায্য নেন। নিজেকে সুস্থ করতে নিজেই ভূমিকা রাখেন।

মানসিক রোগ জিইয়ে রেখে লাভ নাই। বরং যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ সুন্দরভাবে আনন্দে বাঁচেন। জীবনের লড়াইটা জারি থাকুক। সব সংকটে সাহস নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর নামই তো জীবন। আর এটাই সবার জীবনের নিয়ম। শুধু আপনার একার নয়। শুভ হোক।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী