১৩তম কারামুক্তি দিবস

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিকল্পহীন বঙ্গবন্ধু কন্যা

প্রকাশ | ১১ জুন ২০২১, ১২:১৩

আবদুল মান্নান

১১ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৩তম কারামুক্তি দিবস। আজ হতে তেরো বছর আগে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ভোর হওয়ার আগে ধানমন্ডির ৫ নং সড়কে অবস্থিত তার স্বামীর বাসভবন সুধাসদন হতে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে অনেকটা সাধারণ আসামির মতো টেঁনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

পরে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে তিন কোটি টাকা আদায়ের অজুহাতে প্রথমে একটি মামলা দেয়া হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে এগারোটি মামলা রুজু করা হয়। যখন শেখ হাসিনাকে আটক করা হয় তখন তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন। 

এর পূর্বে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়তে গড়িমসি করায় দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে দেশে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর নির্দেশে জরুরি অবস্থা ও কারফিউ জারি করা হয় এবং সেনাবাহিনীর পছন্দ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে একটি বাছাই করা অসাংবিধানিক সরকার গঠন করা হয়েছিল। 

সাংবিধানিক হলে তা সকলের সাথে আলোচনা করে করা হতো আর তার মেয়াদ হতো ছয় মাস। তাদের একমাত্র দায়িত্ব হতো ছয় মাসের মধ্যে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিদায় নেয়া। কিন্তু যখন ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে এই অসাংবিধানিক সরকার গঠন করা হয় আর শেখ হাসিনাকে আটক করতে পুলিশ সুধা সদনে আসে তখন সেই সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ফোন করে শেখ হাসিনা বলেন ‘কাজটি আপনি ভালো করেননি। আমি শিগগিরই মুক্ত হয়ে ফিরে আসব। তখন কাউকে রেহাই দেয়া হবে না। আপনিও না। অতীতে সাহায্যের জন্য আমার কাছে এসেছিলেন, ভবিষ্যতে আবারো আসবেন।’ (বাংলাদেশের তারিখ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রকাশকাল মে ২০১৩)।

ছয় মাসের বেশি থাকার যে সরকারের অধিকার নেই সেই সরকার জোরপূর্বক দুই বছর ক্ষমতা দখল করে রাখে। পরবর্তীকালে নির্বাচন প্রসঙ্গ আসলে বেআইনি সরকারের এই উপদেষ্টা বলতেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা তাদের প্রধান কাজ নয়, তাদের মূল কাজ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা। বঙ্গবন্ধুর কৃপায় ব্যারিস্টার সাহেব ১৯৭৩ এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন সেই কারণেই সম্ভবত শেখ হাসিনা তাকে ফোন করেছিলেন। 

১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দিন আহমেদ অসাংবিধানিক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ফখরুদ্দিন আহমেদের অন্য আর একজন উপদেষ্টা ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন। তিনি প্রায়শ বলতেন তারা ক্ষমতায় এসেছেন দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, তবে এবার চুনোপুঁটিদের ধরা হবে না, ধরা হবে রাঘব বোয়ালদের।

ফখরুদ্দিনের পেছনে আর একটি সরকার চালু করেছিল সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। আসলে দেশে তখন দুটি সরকার চালু ছিল। মঈন ইউ আহমেদের প্রধান কাজ ছিল সৎ বা অসৎ ব্যবসায়ীদের ধরে এনে তাদের কাছ হতে জোরপূর্বক মোটা অংকের অর্থ আদায় করা। তাকে এই ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করতেন বঙ্গবন্ধুর কৃপাধন্য একজন সিনিয়র সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধুর কৃপায় তিনি ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সকল মানুষকে সরলভাবে বিশ্বাস করতেন। সেই জন্যই অনেকের বিরাগভাজন হয়েও তার কন্যার উদ্দেশ্যে প্রায়শ বলি বাবার মতো আপনি সেই ভুলটা করবেন না। যারা তথাকথিত দুর্নীতিমুক্ত করতে ক্ষমতা দখল করে ঠিক তাদের অনেকেই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনাকে আটক করার পর ২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার কনিষ্ঠ পুত্র কোকোকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়। এর আগে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বেগম জিয়ার জেষ্ঠ্য পুত্র তারেক রহমানকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তার বিচার চলাকালে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যাওয়ার সময় তিনি মুচলেকা দেন যে তিনি জীবনে আর রাজনীতি করবেন না। বর্তমানে তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। 

শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়ার আটকের পিছনে অনেকে বলে থাকেন মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতি হতে তাদের মাইনাস করা। আসলে রাজনীতি হতে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম জিয়া বা বিএনপি কোনোটাই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সাথে তুল্য নয়। আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল। তার অনেক ভুলত্রুটি আছে সত্য; কিন্তু একটি দল একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের সকল গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দকে নির্মম ভাবে হত্যা করার পরও আবার ক্ষমতায় ফেরা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

এটি সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের দলের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পিতার মতো ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সাহস ও দেশপ্রেম যার প্রায় সবগুলিই বিএনপিতে অনুপস্থিত। বিএনপি হচ্ছে বহুমতের মানুষের একটি ক্লাব। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি হতে বিদায় করতে দেশের দুটি পত্রিকা ও দু’একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল খোলাখুলি ইন্ধন যুগিয়েছে আর একজন সম্পাদক তো স্বনামে প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয়ও লিখেছিলেন দুই নেত্রী ছাড়া কি ভাবে দেশের রাজনীতি চলবে তা নিয়ে।

বেগম জিয়া আটক থাকাকালে তার দলে বিভক্তি দেখা যায়। অসুস্থ সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে চ্যাংদোলা করে এনে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ঘোষণা করেন এখন হতে তিনিই বিএনপি’র চেয়্যারম্যান। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। দু’একজন শুধু দলের সংষ্কারের কথা বলেছেন। এতে প্রমাণ হয় দু’দলের মৌলিক তফাৎ। দুই নেত্রীকে রাখা হয় সংসদ ভবনের দুটি পৃথক কক্ষে। স্থাপন করা হয় সামরিক আদালতের আদলে বিচারিক আদালত। দণ্ডিত হলে কেউই পরবর্তী নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবেন না। দুজনেরই প্রধান কৌশলী ব্যারিস্টার রফিকুল হক। 

তিনি আদালত হতে বের হয়ে এসে বলেন যেভাবে মামলা চলছে সেভাবে চলতে থাকলে এই মামলাগুলোতে সকলেই সাজাপ্রাপ্ত হবেন। মামলা চলাকালীন সময়ে দলের কিছু সদস্য আইনজীবী আদালতে উপস্থিত থাকতেন। তবে যে দিন বর্ষীয়ান নেতা জিল্লুর রহমান তার পুরোনো কালো কোটটা গায়ে চাপিয়ে শেখ হাসিনর পক্ষে আদালতে হাজির হয়েছিলেন সেদিন আদালতে এক আবেগময় মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল। দেশের ও দলের এই ক্রান্তিকালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। অন্যদিকে যদিও ফখরুদ্দিন আহমেদের অসাংবিধানিক সরকার সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছিল তারাই আবার নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় একাধিক রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ করে দেয় যার মধ্যে নোবেল লরিয়েট ড. ইউনুসের ‘নাগরিক শক্তি’, জেনারেল ইব্রাহিমের ‘কল্যাণ পার্টি’ ফেরদৌস কোরেশির ‘প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পাটি’ অন্যতম। এই সব পার্টিকে বলা হতো কিংস পার্টি।

কারাগারে থাকাকালে শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সকল মহল হতে দাবি ওঠে তাকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর। যতই দিন যায় ততই শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি জোরালো হতে থাকে। এদিকে বিভিন্ন মহল ও আন্তর্জাতিক মহল হতে চাপ আসতে শুরু করে অনির্বাচিত সরকারের বদলে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকারকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেয়ার। ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার বুঝতে পারে শেখ হাসিনাকে কারাগারে রেখে কোনো অর্থবহ নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনাকে আর ১১ সেপ্টেম্বর বেগম জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা ইংল্যান্ড গমন করেন। ৫ নভেম্বর শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন ও ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন।

অনেকে মনে মনে প্রশ্ন করেন যদি শেখ হাসিনা মুক্ত না হতেন তা হলে দেশে কি হতো। যারা বাংলাদেশের রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে কোনো নির্বাচন এই দেশে সম্ভব নয় অন্তত যতদিন শেখ হাসিনা বা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার কেউ একজন রাজনীতিতে আছেন। পূর্বে অনেকে তা করতে চেয়েছেন যা ফলপ্রসূ হয়নি। এটি ঠিক দলের কয়েকজন নেতা শেখ হাসিনা বন্দী থাকা অবস্থায় দলের সংষ্কার চেয়েছেন কিন্তু কখনোই শেখ হাসিনা বিহীন আওয়ামী লীগ চাওয়ার সাহস করেননি যা বিএনপিতে ঘটেছে। সুতরাং এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার বিকল্প গড়ে উঠেনি। বেঁচে থাকুক বঙ্গবন্ধু কন্য শেখ হাসিনা।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন