সেদিন তিনি মুক্ত না হলে...

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২১, ১৯:১০

১/১১ এর সময় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা যেদিন সুধাসদনে ফিরলেন ধানমণ্ডির ৫ নং রোড এবং আশপাশের এলাকা যেন জনসমুদ্র। বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে হাত তুললেন তখন চারপাশে জনতার গর্জন। এই গর্জন সেদিন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল, দেশবাসী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রেরও মুক্তি কামনা করছে। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে বীর বাঙালি। সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট অগণতান্ত্রিক সরকার এবং তাঁদের সুশীল মিত্রদের যোগসাজশে দুর্নীতির মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগে শেখ হাসিনাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার ভয়ংকর খেলায় মেতেছিল তৎকালীন অন্ধকারের শক্তি। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে আসতে পারবেন না। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হল, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামাত-বিএনপি জোটকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের যুদ্ধে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আজ ২০২১ সালে অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছেন।

রাজনৈতিক বুলি নয়, গবেষণা-লব্ধ তথ্য উপাত্তের শক্তিতেই বলা যায়, ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রীর নাম শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের সাক্ষ্য দেয় আজ স্বয়ং বিশ্বব্যাংক, যারা পদ্মা সেতু ইস্যুতে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। অমর্ত্য সেনের মত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল হিসেবে বাংলাদেশের নাম উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। মাথাপিছু আয়ে ভারতের মত পরাশক্তিকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ; শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। বাংলাদেশ এখন শ্রীলংকার মত রাষ্ট্রকে বড় অংকের ঋণ প্রদান করে! ২০২১ সালের মার্চে এসে বিবিসি বাংলা শিরোনাম করেছে “স্বাধীনতার ৫০ বছর: 'তলাবিহীন ঝুড়ি'থেকে যেভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ”। পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ হতে চায়!! না বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য চিরতরে চলে যায়নি। আছে এবং এটা সত্য যে এখনো অনেক মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে।

এখনো শেখ হাসিনা সুস্থভাবে বেঁচে আছেন এবং দলীয় ও রাষ্ট্রীয় কাজে পুরোদমে সক্রিয় আছেন। তাই বেঁচে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল সেটি বলাই বাহুল্য। ২১ আগস্ট এর গ্রেনেড হামলা, ১৭ আগস্ট এর সিরিজ বোমা হামলা, আদালতে বিচারক হত্যাসহ নানা ঘটনায়, সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশের সামনে ছিল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। প্রায় এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার ভোটার তালিকায় ঢুকানো হয়েছিল। এক কোটি ভুয়া ভোট যদি বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনী হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারত তাহলে বাংলাদেশ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যেত। নিজেদের লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে ২০০১ সালের নির্বাচনের মত কৌশল করে পরাজিত করার একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছিল। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বিদেশে বিক্রি করতে চাননি। এর খেসারত দিতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। সবাই মিলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ‘পরাজিত’ হতে বাধ্য করেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে বড় বড় যুদ্ধাপরাধীরা দেশের মন্ত্রী ছিল! ১৯৭১ সালে যারা আমাদের মা-বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, পাকিস্তানী সেনাদের হাতে আমাদের নারীদের তুলে দিয়েছে, যারা দেশপ্রেমিক মানুষের বাড়িতে আগুন দিয়েছে, গণহত্যা চালিয়েছে সেই নরপশুরা ছিল দেশের মন্ত্রী!! নতুন প্রজন্ম তখন ছিল দিশেহারা। সেই অন্ধকার যুগ আরও প্রলম্বিত হোক, এটা শেখ হাসিনা এবং দেশবাসী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই বিশেষ সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনায় সামনে আনা হয় ফখরুদ্দিন আহমেদকে। অনেকটা প্রকাশ্যেই সহযোগিতায় ছিলেন তৎকালীন আর্মি চিফ জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। সাথে যোগ দেয় দেশের কিছু শীর্ষ ‘সংবাদমাধ্যম’। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরতরে মাইনাস করে দেয়ার অভিলাষে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজকের দিনে তিনি মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ নির্মাণের যজ্ঞে নিজেকে আবার নিয়োজিত করেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ১/১১ এর সময় কারাগারে থাকাকালীন শেখ হাসিনা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা কল্পনা করে ফেলেছিলেন। ২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেভাবে ভিশন ২০২১ ঘোষণা করেছিল সেটি সত্যিকার অর্থে বিস্ময়কর ছিল। রূপকল্প ২০২১ বা ভিশন ২০২১ ছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী ইশতেহার। এটি দেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। এরপর কত প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এসেছে! শুরুতেই বিডিআর এর ভেতরে ঘটিয়ে দেয়া হল নারকীয় হত্যাকাণ্ড। শেখ হাসিনার সরকারের মাজা ভেঙে দেয়ার জন্য সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়েছিল। জাতিকে সম্ভাব্য একটি গৃহযুদ্ধের হাত থেকে উদ্ধার করে উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। এই যাত্রাপথে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত হয়েছে, বিচার হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের। দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম শুধু এই কারণেই শেখ হাসিনাকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ২০১৪-২০১৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল-বোমা সন্ত্রাসে বাংলাদেশ আবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবারো ঘুরে দাঁড়ায়।

২০২০ সাল মার্চ থেকে পুরো বিশ্বের মত বাংলাদেশও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কবলে পতিত হয়। শতাব্দীর ইতিহাসে এত বড় দুর্যোগ! ঝড় তুফান তো আছেই। এরপরেও বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মত ৬/৭ লাখ মানুষ এখনো মারা যায়নি বাংলাদেশে। প্রতিবেশী ভারতও যখন ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ এখনো স্থিতিশীল রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা সহযোগিতায় বাংলাদেশ ধ্বংস হওয়া দূরের কথা, বরং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সাহসী অংশগ্রহণে বাংলাদেশ করোনার কাছে এখনো হার মানেনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে যে অন্ধকারে ফেলে দেয়া হয়েছিল সেখান থেকে টেনে তুলে রাষ্ট্রকে একটা আশাব্যাঞ্জক অবস্থানে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার মত সফল নেতৃত্ব আর কারও ছিল না। ভবিষ্যতেও শেখ হাসিনার মত আর কেউ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি না, সেটি এখন জনগণের মনের প্রশ্ন। সবাই বর্তমান নিয়ে আশাবাদী হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। শেখ হাসিনার মত রাষ্ট্রনেতা হুট করে তৈরি হননি। ছাত্রজীবনে তাঁর রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা বাদ দিয়েও যদি ১৯৮১ সাল থেকে হিসেব করি তাহলে দেখা যাবে শেখ হাসিনা একজন বিদগ্ধ, পরিণত, সাহসী, দেশপ্রেমিক, সৎ, নিষ্ঠাবান, শক্তিশালী রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনেতা হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব অর্জন করেছেন। শেখ হাসিনার মত দায়িত্বশীল, আত্মত্যাগী ও সৎ কি অন্য রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী বা সচিবগণ হতে পারছেন?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জার্নালিজম ও মিডিয়া স্ট্যাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :