সব পুলিশ যদি আন্তরিক হতো তবে জনগণ পীর মানতো

প্রকাশ | ১২ জুন ২০২১, ১৪:০২

মো. ইমন

গতকাল রাতে প্রতিদিনের ন্যায় অপারেশনাল কার্যক্রম শেষে রাত ৩টার দিকে বিছানায় আসলাম। শরীরটা ম্যাচ ম্যাচ করছে সারাদিনের ক্লান্তি! ভাবলাম সকালে কোনো কাজ নেই একটু ভালো করে ঘুমাব। যথারীতি মোবাইল ৩টা বালিশের পাশে উচ্চস্বরে রিংটোন সেট করে ঘুমাতে গেলাম (জরুরি সার্ভিস করি সাইলেন্ট করার সুযোগ নেই )।

সকাল ৭ টার দিকে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল। কিছুটা বিরক্তির ভাব নিয়ে রিসিভ করতে ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কান্না জড়িত গলায় এক ভদ্র মহিলা, স্যার আমার জামাইরে বাঁচান স্যার! জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি আর কি হইছে আপনার জামাইর? ভদ্র মহিলা আপনি ইমন স্যার নানি..? বললাম হ্যা।" স্যার আপনি আমরার থানার দারগা আছলা আমার জামাই আপনারে চিনইন, তাইন কইছইন আপনে এখন ঢাকাত থাকইন। আমার জামাই স্যার কারেন্টর শর্ট খাইয়া কান নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়ের ঢাকা মেডিকেল লইয়া আইছি স্যার, কোনরকম ভর্তি করছি এখন রাস্তাত লইয়া বই তাকছি কেউ দেখের না আমার জামাই মরি যাইবা স্যার আপনে একটা ফোন দিয়া কইন ডাক্তারে আমার জামাইরে দেখতা "

কিছুক্ষণ নীরব হয়ে কথাগুলো শুনলাম আর মনে মনে ভাবলাম এটাতো মফস্বল থানা না যে আমি ফোন দিলে আমার কথা কেউ শুনবে! এটা ঢাকা শহর এখানে ইট পাথরের দালানগুলোর মতো মানুষগুলো ও ইট পাথরের তৈরি কেউ কারো নয়। টাকা আর ক্ষমতা থাকলে এখানে সব আছে, নয়তো কিছুই নাই!

গ্রামের সহজ সরল মানুষ তারা কি আর এতকিছু বুঝে..? কি করবো বুঝতে ছিলাম না ঢাকা মেডিকেলের যে অবস্থা ঐখানে একটা বেড পাওয়া সে-তো বিশাল কথা। আবার ভাবলাম এত আস্থা,ভরসা আর বিশ্বাস নিয়ে আমাকে ফোন দিছে কিছু না করলে বেঈমানী হয়ে যাবে না!

আল্লাহর হাওলা বলে বিছানা থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম দেখি গিয়ে কিছু করা যায় কি না। গেলাম ঢাকা মেডিকেলের নিউরোলজি বিভাগের ওয়ার্ডের ভিতরতো জায়গা নাই ই তার উপর তিন তলার সিড়ি বারান্দা সব জায়গায় রোগি হাঁটার ও জায়গা নাই কি এক্টা অবস্থা।

যেহেতু রোগীকে আমি ভালভাবে চিনি না খোঁজ পাওয়া টা তখন বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ালো। অনেক কষ্টে ফোন করতে করতে খোঁজে পেলাম। বিস্তারিত শুনলাম তাদের কাছ থেকে এখন একটা বেড আর কিছু ঔষধের ব্যবস্হা করাটা জরুরি, চারদিকে যত দেখি মনটা আরও ছোট হয় যে আশা নিয়ে এসেছিলাম এখানে কিছু করতে পারব তো? শতশত রোগী বারান্দা আর রাস্তায় তাদের ভিড়ে বেড আমি কোথায় পাব? 

গেলাম ওর্য়াড বয় আর নার্সদের কাছে তারা এত ব্যস্ত যে আমার কথা শুনার টাইম নাই তাদের, আসলে কিছু বলার নাই রোগীর তুলনায় লোকবল তাদের অনেক সংকট এটা সহজে অনুমেয়। তারপরও তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন যেভাবে পারেন। বেশ কয়েক জায়গায় কথা বললাম টাকাও দিতে চাইলাম কোনো কাজ হলো না। হঠাৎ মনে পড়লো ঢাকা মেডিকেলে তো পুলিশ ক্যাম্প আছে দেখি তাদের সাথে কথা বলে তারা কিছু করতে পারে কি না! ক্যাম্পে গেলাম পরিচয় দিয়ে এক ছোট পুলিশ ভাইকে বিস্তারিত বললাম সে বললো স্যার আপনি আমাদের ক্যাম্প ইনর্চাজ স্যারকে বলেন স্যার হয়তো এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।

গেলাম ক্যাম্প ইনর্চাজ স্যারের রুমে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম, তিনি বসতে বললেন বসে বিস্তারিত বললাম উনাকে। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যেহেতু গরীব মানুষের জন্য আসছেন দেখি কিছু করতে পারি কি না। তিনি কয়েক জায়গায় ফোন দিলেন কোথাও কোনো বেড খালি নাই। পরে তিনি বললেন চলেন ফোনে কাজ হবে না ওর্য়াডে যাই গেলে কাজ হবে বলে চেয়ার থেকে ওঠে গেলেন। উনার আন্তরিকতা দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম আর মনে মনে ভাবলাম আমরা সব পুলিশ যদি এভাবে আন্তরিক হতাম তবে পাবলিক আমাদের পীর মানতো!

গেলাম ওর্য়াডে উনি কথা বললেন অনেকের সাথে,পরে বললেন ২ ঘন্টা পর একটা বেড খালি হবে ঐ বেডে আপনার রোগীকে দিবে - যাক একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন রোগীর ঔষধ যোগাড় করতে হবে। একটু পর একজন ডিউটি ডাক্তার আসলেন উনাকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম আর রোগীকে দেখিয়ে বিস্তারিত বললাম। গরীব মানুষ ঔষধ কিনার টাকা নাই আপনি যা ঔষধ লিখে দিবেন আমি কিনে দেব এছাড়া উপায় নাই। ডাক্তার সাহেব মুচকি হাসি দিয়ে বললেন এক কাজ করেন যে ঔষধগুলো আমাদের সাপ্লাই আছে এগুলো আমি দিচ্ছি আর আপনি বাকিগুলো কিনে দেন।

এখন মোটামুটি শরীরে একটা ভাব আসছে যাক বাবা যে আশায় এসেছিলাম মোটামুটি সাকসেসফুল!

এখন রোগীর কাছে বসলাম আর জিজ্ঞেস করলাম আমার নাম্বার পাইছেন কই?  রোগী বলতেছে "স্যার এর আগে দুইদিন বিপদে পড়ে আপনারে ফোন দিছিলাম কাজ অইছে এর লাগি আপনার নাম্বারটা মুখস্থ করি রাখছি যে বিপদে পড়লে আপনারে ফোন দিমু" আমি তো অবাক কবে কোথায় কখন কি বিপদ থেকে উনাকে উদ্ধার করলাম আমার নিজের ই মনে নাই।

যাক পরে ৯০০ টাকার ঔষধ আর ৪৫০ টাকার ফলমূল কিনে দিয়ে আসলাম আর বলে আসলাম দরকার হলে আবার ফোন দিয়েন! এই আস্থা ভরসা আর ভালবাসার দামটা ১৩৫০ টাকা বড্ড কম হয়ে যাবে আমি আরও বেশি কিছু দিতে চাই। ধন্যবাদ ইন্সপেক্টর বাচ্চু স্যার আর নাম না জানা সেই ডাক্তার সাহেব।

লেখক: সহকারী উপ-পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

ঢাকাটাইমস/১২জুন/এসকেএস