চার কোটি টাকায় নদী ভাঙন রোধের উদ্যোগ হাতিয়াবাসীর

প্রকাশ | ১২ জুন ২০২১, ২০:০৮

মিজানুর রহমান রিয়াদ, নোয়াখালী

নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। মেঘনার বুকে থাকা দ্বীপটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় সাত লাখ। মেঘনার ভাঙা-গড়া নিয়ে তাদের জীবন। স্বাধীনতার পর থেকে মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিলিন হয়েছে উপজেলার হাজার হাজার বাড়ি-ঘর, শত শত বাজার, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

এছাড়াও হাতিয়ার তিনটি ইউনিয়ন পুরোপুরি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে হাতিয়ার উত্তর পাশে সুখচর, নলচিরা ও চানন্দি ইউনিয়নের বড় একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙন এই দ্বীপের সবচেয় বড় সমস্যা। তাই নদী ভাঙন রোধ করতে এবার এলাকাবাসী নিজেরাই নেমে পড়েছেন। সাধারণ লোকজনের সহযোগিতায় প্রাথমিকভাবে ৭০০ মিটার নদীর তীরের ভাঙন রোধে কাজ শুরু হয়েছে। আর এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। তবে সরকারি হিসাবে এই কাজে ব্যয় হতে পারে প্রায় সাত কোটি টাকা। সাধারণ লোকজনের পাশাপাশি এই কাজে জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে এসেছেন। সহযোগিতা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক হাতিয়ার নদী ভাঙন এলাকায় ২৯৭ মিটার জায়গায় পরীক্ষামূলক কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হয়। তাতে দেখা যায় এক বছরে ওই জায়গায় নদীর ভাঙন অনেকটা রোধ হয়েছে। সম্প্রতি মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙন উপজেলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র আফাজিয়া বাজারের কাছাকাছি চলে আসে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয়রা।
গত বছরের জিও ব্যাগে ভাঙন রোধ হওয়া তাদের আশা জাগিয়েছে এবং এ ব্যবসা কেন্দ্রকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীরা একত্রিত হয়ে নদীর তীর ভাঙন রোধে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এ কাজে সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন সাবেক সাংসদ ও হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
উদ্যোক্তাদের তথ্য মতে, মেঘনার অব্যহত ভাঙনে যুগ যুগ ধরে নিজেদের অনেক সম্পদ হারিয়েছে দ্বীপবাসী। তাই ভাঙন রোধে সম্প্রতি স্থানীয় ব্যবসায়ী, পল্লী চিকিৎসক, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, প্রবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা উদ্যোগ নেন। আর এ কাজের জন্য গঠন করা হয় ৫১ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘হাতিয়া নদী শাসন ও  তীর সংরক্ষণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন’।
সংগঠনটির সভাপতি করা হয়েছে উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন আহম্মদকে। সাধারণ সম্পাদক হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মহি উদ্দিন মুহিন। সাবেক ইউপি সদস্য আজহার উদ্দিনকে করা হয়েছে অর্থ সম্পাদক। সবার সহযোগিতার অর্থ জমা নেয়ার জন্য খোলা হয়েছে একটি ব্যাংক হিসাব। এই কাজে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা আনার জন্য সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে খোলা হয়েছে একটি পেইজ। এতে প্রতিদিন অনুদান দেয়া লোকজনের নাম, পরিচয় ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে তথ্য দেয়া হচ্ছে এবং এ কাজে এগিয়ে আসতে সাধারণ মানুষকে অনুরোধও করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের ভিটে মাটি রক্ষায় এই সংগঠনের একাউন্টে টাকার অনুদান জমা দেয়া শুরু করেছেন। গত মে মাসে এই অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। প্রাথমিকভাবে দুই দফায় গাজীরপুরের একটি কারখানা থেকে গত ৩০ মে ২৪ হাজার জিও ব্যাগ এনে নলচিরা ঘাটের পশ্চিম পাশে ২০০ মিটার ও পূর্ব পাশে ৫০০ মিটার ভাঙন রোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। যা শেষ হতে প্রায় ছয় থেকে সাত মাস লাগতে পারে।
প্রতিদিন ব্যাগগুলোতে বালু ভর্তি ও ডাম্পিংয়ের কাজ করছেন রংপুর জেলা থেকে আসা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ৫০ জন শ্রমিক। তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় লোকজন। দ্বীপের লাখো মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এখন দ্বারপ্রান্তে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
সংগঠনের তথ্য মতে, গত ৩০ এপ্রিল স্থানীয় আফাজিয়া বাজারে বিভিন্ন পেশার প্রায় সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে টাকা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের আর্থিক অবস্থানুযায়ী অনুদান জমা দিতে শুরু করে। হাতিয়ায় বসবাস করা লোকজন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশ থেকে অনেকে এ কাজে আর্থিক সহযোগিতা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সর্দার আলতাফ হোসেন বলেন, আর্থিক সংকট থাকায় তিনি টাকা দিয়ে সহযোগিতা না করতে পারলেও তিনি এবং তার লোকজন জিও ব্যাগে বালু ডুকানোর কাজে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছেন।
নদী ভাঙন কবলিত নলচিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বাবলু জানান, নদী ভাঙন রোধ করা আমাদের প্রাণের দাবি। করোনার কারণে সরকারিভাবে না হওয়ায় আমরা নিজেরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা আমাদের ইউনিয়নের প্রতিটি বিত্তবান পরিবারের কাছে আর্থিকভাবে সহযোগিতা চেয়েছি। অনেকে করেছেন আবার অনেকে আর্থিক অনুদান দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছেন প্রবাসীরা ভাইয়েরা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন মুহিন জানান, আমাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছি সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় আর্থিক সহযোগিতা তিনি করেছেন। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি চার লাখ ফুট বালু ও নগদ ২০ লাখ টাকার অনুদান দিয়েছেন। এটি আমাদের প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সহযোগিতা। আমরা আমাদের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীও সহযোগিতা করছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাছির উদ্দিন বলেন, হাতিয়া নদী শাসন ও তীর সংরক্ষণ কমিটির লোকজন তাদের কাজে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে তাদের কাজের জন্য ১০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তীর সংরক্ষণে কাজ শুরু করা নলচিরা ঘাটে পানির গভীরতা অনেকটা কমে গেছে। তাতে জিও ব্যাগ ফেললে তার সুফল পাওয়া যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তাদের একটি ডিজাইন ঠিক করে দেয়া হয়েছে। আমাদের একজন প্রতিনিধি এ কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।
তিনি জানান, মাটি ভর্তি ও ডাম্পিংসহ প্রতিটি জিও ব্যাগে খরচ পড়বে ৫০০ টাকা করে। প্রতি মিটারে খরচ পড়বে প্রায় এক লাখ টাকা করে। সেই হিসাবে ৭০০ মিটার কাজ সম্পূর্ণ করতে তাদের খরচ পড়তে পারে প্রায় সাত কোটি টাকা।
(ঢাকাটাইমস/১২জুন/কেএম)