আর কত নীরবে ছড়াবে এই রোগ?

ডা. নুসরাত সুলতানা
 | প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০২১, ১৪:২০

মেয়েটি একটি কাগজ হাতে নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। খুব ভীত, চিন্তিত চেহারা। কাগজের ভেতর কি লেখা আছে ও জানেনা। পাশে ওর ননদ। মেয়েটির ৬ ও ৩ বছর বয়সী দুটি শিশুও একটি চেয়ারে বসে খুনসুটি করছে।

আট বছর আগে দক্ষিন আফ্রিকা প্রবাসী মইনুলের সাথে নাজমার বিয়ে হয়। বিয়ের জন্যে তিনমাসের জন্য সে দেশে আসে। যাওয়ার সময় নাজমা গর্ভবতী ছিল। সন্তানের যখন ২ বছর, আবার মইনুল দেশে আসে। এবারো নাজমা গর্ভবতী। স্বামীর সাথে দূরত্বকে মেনে নিয়ে নিমগ্ন হয়ে মনযোগের সাথে দুটি মেয়েকে লালন পালন করতে থাকে নাজমা। ভিডিও কলই একমাত্র উপায় একটু ভালোবাসার আলাপ করার।

প্রায় একমাস ধরে মইনুলের ডায়রিয়া, ক্ষুধামন্দাও। ওজন যথেষ্ট কমে গেছে। জিভে ও ঘা হয়েছে। ফোনে কথা বলার সময় নাজমা খেয়াল করে মইনুল একটুতেই হাঁপিয়ে উঠে। কাজ ও নাকি তেমন করতে পারেনা। দুই তিন মিনিট কথা বলেই ফোন রেখে দেয়। নাজমা বারবার ডাক্তার দেখাতে বলে মইনুলকে।

এভাবে কেটে যায় কিছুদিন। তারপর মইনুল আর ফোন করেনা। নাজমা ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করেনা। বেশ কয়েকটা দিন এমন চলে। দুশ্চিন্তার প্রহরগুলো গোনা যে কত কঠিন তা ও ছাড়া আর কে বুঝবে? হঠাৎ একদিন অপেক্ষার অবসান হলো। মইনুলের নম্বর থেকে ফোন এলো। অভিমানী চোখের জল যেন বাধ মানেনা নাজমার। একবার ভাবে ফোনটা ধরবেইনা। মানুষটাকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। কি মনে করে ফোনটা ধরল। কন্ঠস্বর শুনে শিড়দাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন, এ যে তার মইনুলের কন্ঠস্বর নয়।

- ভাবি আমি রিয়াজ। মইনুলের বন্ধু। ও হাসপাতালে ভর্তি।

- কি হইসে ভাই?

- কেমনে বলি ভাবি? আপনার ও আপনার মেয়েদের একটা টেস্ট করাইতে হবে। ওর এইডস হইসে। ছোঁয়াচে রোগ। এইডস এর জীবানু আপনাদের শরীরে ছড়াইসে কি না, তা পরীক্ষা করতে হইব। আমি টেস্টের নাম মেসেজ করতেছি।

- সে কেমন আছে? কথা বলব তার সাথে। ফোনটা দেন।

- ও কথা বলার অবস্থায় নাই ভাবি। খুব খারাপ অবস্থা।

বলেই ফোনটা কেটে দিল রিয়াজ। কিছুক্ষণ পর মেসেজ করে পাঠালো রক্তের টেস্টের নাম।

পাশের বাসাতেই নাজমার ননদ থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে গেল। খুলে বলল সব কথা।

পরেরদিন নাজমা আর তার দুই মেয়েকে নিয়ে ননদ আসলেন ঢাকা মেডিকেলে কলেজের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টে। নাজমা মেয়েদের টেস্ট করানোর সাহস পেল না। নিজের রক্ত দিয়ে গেল।

এই রিপোর্ট নিয়ে আমি আর নাজমা মুখোমুখি। আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে আছে সে। আমি জানি ওই কাগজে কী লেখা আছে? আমি জানি তার রক্তে এইডস এর জীবানু HIV রয়েছে।

তবুও রিপোর্ট হাতে নিলাম। অনেক স্বান্তনা দিলাম। মেয়েদের টেস্ট করাতে বললাম। রেফার করলাম বিএসএমএমইউ এর HIV/ AIDS ক্লিনিকে।

একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে নাজমা। মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমি ওর চলে যাওয়াটা দেখছিলাম আর মনের মাঝে ভেসে উঠছিল নাজমার করুন পরিণতি। নির্দোষ এই সংসারী মেয়েটির মানসিক ও সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়াটা দেখছিলাম কেবল।

জানিনা মেয়ে দুটোর টেস্ট করিয়েছে কি না। জানিনা তাদের মাঝে কারো শরীরে এইচ আইভি এর জীবানু আছে কি না। জানিনা আর কত নীরবে ছড়াবে এই রোগ।

লেখক: ডা. নুসরাত সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, ভাইরোলজী বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :