পারিবারিক বিরোধের জের: হবিগঞ্জে ৩০ দিনে ছয় খুন

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২১, ২২:২২

আবু হাসিব খান চৌধুরী পাবেল, হবিগঞ্জ

জেলায় ৩০ দিনে ৬ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় একটি করে খুন হলেও বানিয়াচঙ্গে ৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। মামির হাতে ভাগ্নে, ভাগ্নের হাতে মামা, ছেলের হাতে মা, ছোটদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বড়দের সংঘর্ষ, বিয়ের আলোচনায় আমন্ত্রণ না পাওয়ার ক্ষোভে হবু বরকে খুন ও হাতাহাতির জেরে দুইপক্ষের সংঘর্ষে এসব হত্যার ঘটনা ঘটে। আর এর কারণ হিসেবে নৈতিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন পুলিশসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মে সন্ধ্যায় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও বাজারে শের আলী এবং কামাল মিয়া নামে দুইজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরদিন সকালে উভয় গোষ্ঠীর লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে কামাল মিয়া নিহত ও অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ আহত হন। পুলিশ দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত ৩৪ জনকে আটক করে।
১২ মে বানিয়াচং উপজেলার পুরান পাথারিয়া গ্রামের কালু মিয়া ও তার চাচাতো মামা জাহির মিয়ার মধ্যে বাগ-বিতণ্ডা হয়। ফিকলের আঘাতে মামা কালু মিয়া আহত হন। পরে তাকে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ব্যক্তির ভাগ্নে অভিযুক্ত জহিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
গত ১৯ মে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শৈলজুড়া গ্রামে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সজিব মিয়া নামে এক যুবক খুন হন। ঘটনার পর উজ্জ্বল মিয়া নামে আরেক যুবক সজিবকে খুন করেছেন বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সজিবের সঙ্গে উজ্জ্বলের শ্যালিকার বিয়ের আলোচনা চলছিল। এ আলোচনায় বড় জামাই হিসেবে নিমন্ত্রণ না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই উজ্জ্বল খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।
২৩ মে শিশুদের ফুটবল খেলা নিয়ে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে নবীগঞ্জ উপজেলার কলাবরপুর গ্রামে আবুল মিয়া ও আব্দুল মতিনের পরিবারে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দিলবর মিয়া নামে এক ব্যক্তি নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় ফারুক মিয়া নামে একজনকে নবীগঞ্জ থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
২৬ মে বানিয়াচং উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ও আব্দুল বারিক নামে দুইজনের বিরোধ মীমাংসায় একটি সামাজিক বিচার বসে। এ সময় দুইপক্ষের সংঘর্ষ হলে ফিকলের আঘাতে মোহাম্মদ আলীর মা বৃদ্ধ গোলাপজান বিবি মারা যান এবং পুলিশ মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে।
পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতিপক্ষের লোকজনকে ফাঁসাতেই নিজের ফিকলের আঘাতে তার মাকে হত্যা করে।
২৭ মে বানিয়াচং উপজেলার আদর্শ গ্রামের জলাশয় থেকে মোহাম্মদ আলী নামে তিন মাস বয়সী শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে হত্যার দায় স্বীকার করে ওই শিশুর মামি তুলুনা বেগম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।  
স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, শিশুটিকে ঘরের বিছানায় রেখে তার মা পার্শ্ববর্তী বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন। এ সুযোগে তুলুনা বেগম শিশু মোহাম্মদ আলীকে জীবিত অবস্থায় জলাশয়ে ফেলে দেন। শিশু মোহাম্মদ আলীর নানি (তুলুনার শাশুড়ি) মোহাম্মদ আলীকে তার একমাত্র মেয়ের চেয়ে বেশি আদর করতেন। এর জন্য তুলুনার হিংসা হতো। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করেছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জেলা সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, সমাজে সুস্থ চিন্তা চর্চা এবং উন্নত মননশীলতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে জন্য সমাজে এখন খুন খারাপের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
লোভ-লালসা ও হিংসা বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়ে মানুষে মানুষে মায়া মমতা কমে গেছে। এসব থেকে বের হতে হলে পুলিশের পক্ষে একা সম্ভব নয়। আমাদেরকে সকল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে গ্রাম্য রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই সাথে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষার হার যত বাড়বে গ্রাম্য দাঙ্গা তত কমবে।   
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও প্রশিকিউশন) শৈলেন চাকমা বলেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে অধিকাংশ গ্রাম্য দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটছে। এগুলো বন্ধ করতে হলে পুলিশের পক্ষে একা সম্ভব নয়। জনপ্রতিনিধি, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করতে হবে। আমরা সকলে মিলে কাজ করলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব গ্রাম্যদাঙ্গা বন্ধ করা সম্ভব হবে। জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে।
ইতোমধ্যে পুলিশ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে এবং অনেকে স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমা দিয়ে আর দাঙ্গায় জড়াবে না বলে অঙ্গীকার করেছেন।
(ঢাকাটাইমস/১৩জুন/এলএ)