পরীমনি ইস্যুতে সমালোচকদের কাছে রুম্মান রশীদের একগুচ্ছ প্রশ্ন

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০২১, ১৫:৫৮

বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

‘শুরুতে ভেবেছিলাম, পরীমনির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ হ্যাকড হয়েছে। তারপর মনে হলো, পরীমনি যে আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন, সেটা তো হ্যাকারের জানার কথা নয়। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত হলাম, ঘটনা সত্য। তারপর থেকেই আমি কেমন যেন ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত হয়ে গেলাম। সবাই স্ট্যাটাস দিচ্ছে, কমেন্ট করছে, আমি পড়ছি, পড়ছি এবং পড়ছি। কিছু লেখার ব্যাপারে হাত নিষপিষ করছিল; কিন্তু সব শব্দ এক করে গুছিয়ে লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যেতে পারে- এই আশংকায় বেদনার্ত মন নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।’

‘ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই দেখলাম, ইনবক্স ভর্তি জিজ্ঞাসার পাহাড়-‘আপনি কোন পক্ষ?’ মিতু বললো, তোমার কিছু একটা লেখা উচিত। অন্যায় যার সাথেই হোক, প্রতিবাদ করা উচিত। অবশ্যই আমি প্রতিবাদ করতে চাই, তবে যে কোনো কারণেই হোক, ফেসবুক যেহেতু এখন একটি ভার্চুয়াল আদালতের (!) মর্যাদা পেয়ে গেছে, এই আদালতের সামনে কিছু প্রশ্নও ছুঁড়ে দিতে চাই; যারা অবিরাম পরীমনির চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে-

পরীমনির কান্নাও অনেকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। পুরোটাই নাকি স্ক্রিপ্টেড। একজন নিকৃষ্ট মানুষও নিজের ইজ্জত নিলামে তুলেন না। আপনারা কিভাবে নিশ্চিত হলেন পুরো বক্তব্যই স্ক্রিপ্টেড? প্রমাণ দিন।

সংবাদ সম্মেলনে পরীমনির কথাবার্তা নাকি ছিল অগোছালো। তার মানে, একজন মেয়ে, যার ওপর সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করা হয়েছে, সেটার বর্ণনা বারংবার দেয়ার সময়ও সেই মেয়েটিকে স্মার্টলি উত্তর দিতে হবে, গুছিয়ে কথা বলা শিখতে হবে? নইলে পুরোটাই স্ক্রিপ্টেড মনে করতে হবে?

পরীমনি জানতেন, তার ফেসবুক পোস্টের পর পক্ষ-বিপক্ষ মতামতে চায়ের কাপ থেকে ভাতের প্লেটে ঝড় উঠবে। এজন্যই সাধারণ মেয়ের জায়গা থেকে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন ৪ দিন, বিচারের আশায়। বিচার কি তিনি পেয়েছিলেন? যদি সত্যিই attention পাবার ইচ্ছে থাকতো, ৪ দিন আগেই তো তিনি পোস্ট দিতে পারতেন। কেন মনে হয় আপনাদের, এরকম ঘটনা পরীমনির সাথে এবারই প্রথম হয়েছে বা শুধু পরীমনির সাথেই এরকম হয়েছে? এরকম ঘটনা অহরহ হচ্ছে। কেউ বিচার চায় না, চাইলেও পায় না। কেউ মৃত্যুর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়, তখন RIP RIP শোক ধ্বনিতে আমরা সামাজিক সব মাধ্যম মুখর করে ফেলি। পরীমনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেও অবশ্যই তাই হতো। তিনি বিচার চেয়েছেন বলেই কি আমাদের ইগো মনের অলক্ষ্যে জেগে উঠেছে? মনের গভীরের ঈর্ষাগুলো (পরী কেন ৩ কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করবেন, কেন এত বিলাসবহুল জীবন যাপন করবেন, কেন এত ব্যয়বহুল জন্মদিনের পার্টি করবেন) জেগে উঠেছে? আমরা কি খোদা, নাকি আমাদের কাছে কোনো রাষ্ট্রীয় হুকুম রয়েছে-মানুষের চরিত্রের ময়নাতদন্ত করার? আমরা শতভাগ চরিত্রবান মানুষ? আয়না কি বলে? আমরা কেন একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্যলুট না জানিয়ে ধিক্কার জানাই।’

‘ঘটনার দিন ভিক্টিমের পরিশ্রমের পারিশ্রমিক নিয়ে নাকি বনিবনা হয়নি বলে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে মিথ্যেমিথ্যি ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে বোট ক্লাবের সাবেক সভাপতিকে। আপনারা কিভাবে নিশ্চিত হলেন? প্রমাণ আছে? প্রমাণ দিন।

ধরে নিলাম, পরীমনি এ সমাজের সবচাইতে নিকৃষ্ট প্রাণী। অনেকের ব্যবহার করা শব্দ অনুযায়ী, তিনি ‘বেশ্যা’। তার মানে বেশ্যাদের সাথে ধর্ষণ করা জায়েজ? গলা দিয়ে মদের বোতল জোরপূর্বক প্রবেশ করানো জায়েজ? তাকে লাত্থি দেয়া জায়েজ? তার মানে হিন্দি ‘পিংক’ সিনেমা দেখে হাত তালি দেয়া দর্শকরা শুধু নাটক-সিনেমাতেই দেখতে চান ‘নো মিন্স নো’? বাস্তবে একজন মেয়ে/ বেশ্যা/ নায়িকা হলে তার সাথে যা খুশি করা যাবে? আপনি তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখতেই পারেন। কিন্তু ধর্ষণ করতে পারেন? তারকা ভুলে গেলাম। একজন মেয়েকে কখনোই কি আমরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করতে পারি? চড়, লাত্থি, আচড় যেটাই হোক! পারি?

• সাংবাদিক ভাইদের অনেককেও দেখলাম, বিষয়টি নিয়ে তামাশা করতে। ধরে নিলাম, পরীমনি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন বা জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াত দেননি বা অতীতে আপনি বিনা দোষে তার কাছে অপরাধী হয়েছেন, তারপরও একজন মেয়ের কান্না নিয়ে বা তার বিচার চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে হাসি-তামাশা করার শিক্ষা আপনাকে কে শিখিয়েছে? সাধারণ মানুষের বর্বরতার চিত্র তো যে কোনো তারকার কমেন্টবক্সে চোখ রাখলেই দেখা যায়। কিন্তু আপনি সাংবাদিক হয়ে, বিনোদন জগতের একজন হয়ে, আপনার অঙ্গনেরই একজনকে নিয়ে কি করে ঠাট্টা মশকরা করতে পারেন? আপনার পরিবারের একজন নিকৃষ্ট (!) বোনকে নিয়ে যদি বাইরের মানুষ হাসে, আপনিও কি তাদের দলে শরীক হয়ে বোনের বিরুদ্ধে কথা বলবেন? তাছাড়া অনেকের ভাষায়, পরীমনি যদি এতই সাংবাদিকদের গণায় না ধরতেন, তার জন্মদিনে সিনিয়র-জুনিয়র, বড়-ছোট সব পত্রপত্রিকার সাংবাদিকরা কি করে আমন্ত্রিত হতেন? তার সম্পর্কে প্রকাশিত সব খবর (বিখ্যাত-অখ্যাত সব পত্রিকা/ পোর্টাল) নিয়ম করে কেন ধন্যবাদ জানিয়ে শেয়ার করতেন? অনেকেই তো করেন না। পরীমনিও না করলেই পারেন।  

• কেউ কেউ বাণীর ভান্ডার খুলে বসেছেন কাল থেকে- আসুন সৎ রাস্তায় বড় হই। কষ্ট কম, রিস্ক বেশি / এত লোভ ভালো না, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। কাছের মানুষ/ বিশ্বস্ত বন্ধুদের সাথে বের হয়ে বন্ধুর অনুরোধে ৫ মিনিটের জন্য বোট ক্লাবের টয়লেট ব্যবহার করা লোভ? ক্লাবের সাবেক সভাপতির হুকুম অমান্য করা লোভ? কিংবা যদি অন্য প্রসঙ্গে বলি, প্রতি বছর ঈদে দুস্থ শিল্পীদের জন্য গরু কোরবানী দেয়া লোভ? নিজের জন্মদিনের দিনের বেলার পুরোটা সময় এতিমখানার বাচ্চাদের সাথে কাটানো লোভ? আরো তো অনেক সম্পদশালী তারকা আছেন। নতুন বন্ধু/ সহকর্মী তো বটেই, স্বার্থহীন পুরনো বন্ধুদের ভুলে না গিয়ে তাদের নিয়ে বছরের পর বছর নিজের জন্মদিন উদযাপন করা লোভ? বাসার গৃহপরিচারিকার বোনের বিয়ের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করা লোভ?

• কিছুদিন আগে একটি অনলাইন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, পরীমনি দুবাই ঘুরতে গেছেন একটি গ্রুপের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার সাথে। সেই কর্মকর্তা একটি হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, আশ্রয় নিয়েছেন পরীর কাছে। আমার প্রশ্ন, সেই ঘটনা সংগঠিত হবার ৬ দিন আগে থেকেই তো পরীমনি দুবাইয়ের ছবি আপলোড করছিলেন। এমনকি পরীমনি এই ঘটনার সাথে জড়িত আছেন-এমন খবর প্রকাশের পরও তো পরীমনি ছবি আপলোড করেই যাচ্ছিলেন (স্বাভাবিক নিয়মে তো তার সংকুচিত হয়ে যাবার কথা)। আমরা কিভাবে নিশ্চিত হলাম, সেই কর্মকর্তা সত্যিই দেশ ছেড়েছেন? কোনো প্রমাণ আছে? এমনো তো হতে পারে, সেই কর্মকর্তা দেশেই ছিলেন।

অবশ্য ছিদ্রান্বেষীদের এসব বলেও বা কি হবে? তনু-নুসরাত-মুনিয়াদের বিচার না হলে বুক ফুলিয়ে নারীর দিকে আঙুল তোলাটাই যেন নষ্ট সময়ের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক ফোর্বস ম্যাগাজিনে যার নাম আসে, সেই তারকাকে যদি জনৈক সম্পশালীর কাছে অপদস্ত হতে হয়, সেই খবর যদি আবার বিবিসিতে আসে, অপমানটা কিন্তু আমাদের সবার গায়েই লাগে, অন্তত আমার লাগে। বিস্মিত মন বার বার জানতে চায়, যার ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা সবচাইতে বেশি, সেই তারকা যদি এতই নিকৃষ্ট হন, আমরা তাকে বয়কট কেন করিনা?

পরীমনি সংবাদ সম্মেলনে ততটুকুই বলেছেন, যতটুকু সবার সামনে/ গণমাধ্যমে বলা যায়। সত্যি কাহিনী এর চেয়েও অনেক নৃশংস। কস্টিউম ডিজাইনার জিমিকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন। গা শিউরে যাবে। সময়ের একজন শীর্ষ জনপ্রিয় শিল্পীর সাথে এমন-ও হতে পারে! আমি কণ্ঠ জোরালো করে পরীমনি ও জিমির সাথে ঘটে যাওয়া এই জঘন্য, নেক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সুবিচার চাই। কারণ চিত্রনায়িকা পরীমনি হোক বা গাঁও গেরামের সখিনা-জরিনা, সবারই ন্যায় বিচার পাবার অধিকার আছে। যদিও বিচারটা শুধু রাষ্ট্রীয় আদালতেই না, মনের আদালতেও হওয়া উচিত। কারো দিকে আঙুল তুলে নিকৃষ্ট কথা বলার আগে শতবার ভাবা উচিত। কারণ এটা মধ্যযুগ না, ২০২১! 

চিত্রনাট্যকার রুম্মান রশীদের ফেসবুক থেকে নেয়া

ঢাকাটাইমস/১৬জুন/এএইচ