পরিবেশের ওপর কংক্রিটের আস্তরণের আধিক্যের প্রভাব ও পর্যালোচনা

শেখ মোজাহীদ
 | প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২১, ১৯:১৯

গত ০৯ জুন, ২০২১ বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সংবাদের শিরোনাম ছিল বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শেষ চারে ঢাকা। অর্থাৎ শেষের দিক থেকে ঢাকা চতুর্থ। আরো সহজ ভাবে বললে বোঝাই, বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ঢাকা। প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনোমিস্ট এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক প্রতিবছর বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের যে তালিকা তৈরি করা হয় সেখানে এবছর ১৪০ টি শহরের মধ্য ঢাকার অবস্থান হল ১৩৭তম।

বিষয়টি যে এই প্রথম তা কিন্তু নয়। আগেও এই তকমা জুটেছে আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরীর। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ এর উপর ভিত্তি করে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট এই তালিকা প্রস্তুত করে। কোনও ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্জিত স্কোর মোটেও সন্তোষজনক নয়। ২০২১ সালে অর্জিত স্কোর বিশ্লেষণে দেখা যায় ১০০ নম্বরে ঢাকা পেয়েছে ৩৩.৫ নম্বর। দেশের জনগণ বিশেষ করে যারা ঢাকায় বসবাস করেন তাদের জন্য এটা যথেষ্ট উদ্বেগ এবং লজ্জার। অথচ আমরা একটু সচেতনভাবেই সচেষ্ট হলে আমাদের প্রিয় এই নগরটিকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

আজকের নিবন্ধে আমরা ঢাকা শহরের পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করবো। ঢাকা শহরের বিদ্যমান প্রায় সবগুলো পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায় থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ ও জলাশয় ভরাট প্রতিরোধ, অপরিকল্পিত ও দূষণকারী ফ্যাক্টরি ও কারখানা স্থানান্তর ও বন্ধ, জলাবদ্ধতা প্রতিরোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সকল প্রকার পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আজকের নিবন্ধের শিরোনামে বর্ণিত বিষয়ের প্রতি এখনো উল্লেখযোগ্য কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না বললেই চলে।

ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত কংক্রিটের আস্তরণ। কংক্রিটের আস্তরণের এই আধিক্য ঢাকা শহরে সৃষ্টি করেছে একাধিক পরিবেশগত সমস্যা। পাশাপাশি এ শহরের পানি ব্যবস্থাপনার উপরে ফেলছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে একটি বসবাসযোগ্য শহরের কমপক্ষে ৩০-৩৫ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত জায়গা হিসেবে থাকতে হবে। এই উন্মুক্ত জায়গার ১০-১৫ শতাংশ জলাশয় এবং ১৫-২০ শতাংশ সবুজে আচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরের মোট ভূমির মাত্র ৪.৬১ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত হিসেবে টিকে আছে।

অথচ নগর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইনে কোথায় কতটুকু জায়গা উন্মুক্ত রাখতে হবে তা স্পষ্ট করেই বলা আছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্লানার্স (বিআইপি) এর সাম্প্রতিক সময়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঢাকার ৮২ ভাগ এলাকা কংক্রিটে ঢেকে গেছে। অথচ ১৯৯৯ সালে যা ছিল ৬৪.৯৯ ভাগ। আরো উদ্বেগের বিষয় হল রাজধানীর অধিকাংশ পার্ক বা উদ্যানগুলোর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আশঙ্কাজনকভাবে কংক্রিটের আচ্ছাদনের পরিমাণ বেড়েছে।

এসমস্ত পার্ক বা উদ্যানগুলোর প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে কংক্রিটের আস্তরণ, চলার পথ ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। বিআইপির গবেষণায় দেখানো হয়েছে কোন কোন পার্কের অর্ধেকের বেশি জায়গা কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের বিদ্যমান পরিবেশগত দিক বিবেচনায় এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বৈশ্বিক বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে ঢাকা শহর নেতিবাচক হওয়ার এটি অন্যতম একটি কারণ।

একটি শহরে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্মুক্ত জায়গা না থাকে তবে তা শহরের পানি ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। পানি সহজে মাটির অভ্যন্তরে শোষিত হয় না। হঠাৎ ভারী বৃষ্টি ও বন্যায় শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বর্তমান সময়ে যা আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।কংক্রিটের আস্তরণ থাকায় পানি মাটির নিচে চলে যেতে পারে না। ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। তখন এর সরাসরি প্রভাব পড়ে শহরের জনজীবন এবং উদ্ভিদের উপর। একদিকে মাটিতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় স্বল্প শিকড় বিশিষ্ট উদ্ভিদ মারা যায়। আবার জলাবদ্ধতার সময় পানির আধিক্যে উদ্ভিদের স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। সার্বিকভাবে শহরের কিছু প্রজাতির গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরের স্থানীক তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তা ছাড়া কংক্রিটের অধিক আস্তরণের কারণে মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটে। পরিবেশবিদদের মতে কংক্রিটের আস্তরণের আধিক্যের কারণে বৃষ্টিপাতের প্রায় ৫০ শতাংশ পানি হারিয়ে যায়। প্রকৃতি কিংবা মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে না। কংক্রিটের তৈরি ড্রেন বা নালার কারণে পানি ঠিকমতো বাষ্পীভূত হতে পারেনা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পানিচক্র বিঘ্নিত হয়। বাষ্পীভূত বিঘ্নিত হলে গরম বেড়ে যায়। সার্বিকভাবে যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরের বর্তমান বাস্তবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কংক্রিটের স্থাপনা ও আস্তরণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য শহরের জন্য অবশ্যই যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় কংক্রিটের স্থাপনা ও আস্তরণ নির্মাণ পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। ঢাকা শহরের সার্বিক নান্দনিকতা সৃষ্টিতে এবং সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ রক্ষায় এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :