বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
 | প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২১, ১৩:২৮

প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনও সিডর, কখনও সুনামি, কখনও আইলা, কখনও হারিকেন, কখনও নার্গিস, কখনও ফনি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, আম্পান, সর্বশেষ ইয়াস বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দুর্যোগ আকারে দেখা দিচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোজার ঠাঁই।

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা। খরা ও মরুকরণ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস।

বিশ্বের জলাভূমির প্রায় ৭০% ইতিমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিস্কাষণে অব্যবস্থাপনা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতারাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।

আজকের দুনিয়ার পরিবেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মরুকরণ অন্যতম। জাতিসংঘ বলেছে, পৃথিবীর প্রায় দেড়শ কোটি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ক্ষয়িষ্ণু ভূমির উপর নির্ভরশীল। আর পৃথিবীর অতি দরিদ্রদের প্রায় ৪৩ ভাগই বাস করে ক্ষয়ে যাওয়া এলাকায়। যারা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এই ভূমিক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে, যা শুধু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই বিপদের কারণ নয়; বরং এটি আমাদের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।

মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথা ব্যাথার কারণ তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারন রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ঠ হচ্ছে। একই সংগে কমছে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদী হলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সঙ্খিন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সংগে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।

জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সে সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশঙ্খা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এই সংকটের একমাত্র কারন হবে মরুকরণ ও খরা।

মরুকরণ এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।

মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষন করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্খা করছেন। তারা বলেছেন মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈবসার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পাণি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমি সমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।

অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ হিসাবে মাটির জৈব পদার্থের পরিমান যদি পাঁচ ভাগ থাকে তাহলে তা উর্বর মাটি। দেশের কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমান বর্তমানে এক শতাংশ। রাসায়নিক সার ব্যবহার ও শাক সবজির বদলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় মাটি গুনাগুন হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে।

বর্ষা বা শীত মৌসুমে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি চাষ করলে কৃষি জমির ঊর্বরতা বাড়াতো। কিন্তু এখন দীর্ঘ দিনের সেই প্রথাগত চাষ বন্ধ। জমির অনুর্বরতা ঠেকাতে জৈব চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু তা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে রাসায়নিক সারের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের কৃষিজমি পুরোপরি অনুর্বর হয়ে পড়বে। যা মরুকরণে ঝুঁকির একটি প্রধান দিক।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। বিশেষত রাজশাহী অঞ্চল এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। অত্যান্ত জরুরী হলেও বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস এদেশে বিশেষ গুরুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তবে মরুকরণ রোধে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপন কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। মরুকরণ বিস্তার রোধে অধিক বৃক্ষ রোপনই হচ্ছে সর্বধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষুন্ন রাখতে পাওে, সেসব বৃক্ষ রোপন করার ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে গৃহীত মূল প্রস্তাবে বৃক্ষ রোপন এবং বিকল্প জ্বালানি সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

অনেকেই আশংকা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীব-বৈচিত্র, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকুলীয় এলাকার ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বণ্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের।

পানিসম্পদ মন্ত্রনালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এরমধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। এদিকে সেন্টার ফর এনভয়রনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিইউএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাধারণ হিসাবে গত ৪০ বছরে শুধুমাত্র তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা-এই তিনটি নদীতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লাক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতি বছর কোন না কোন নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুদের হাতে। পরিকল্পনার অভাবেই নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে এভাবে নদী হারিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সংগে পালনের আহবান জানালেও বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্বেও সংগে পালন হচ্ছে না। অথচ অনেক গুরুত্বহীন দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যময় উদযাপন প্রত্যাশা করি।

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করুক। খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধসহ কৃষিজমি রক্ষায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হোক এ প্রত্যাশা থাকল।

লেখক: কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ এবং সমন্বয়ক, মিডিয়া সেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :