৭৯তেও প্রাণচঞ্চল অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
| আপডেট : ১৭ জুন ২০২১, ১৬:৩৪ | প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২১, ১৬:২১

শুভ জন্মদিন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। একজন আদর্শ বাঙালি, যিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেও বিদেশি চিন্তা-চেতনার অর্থনীতিবিদদের মতো এদেশের কিছু সংখ্যক অর্থনীতিবিদের মতো পাশ্চাত্য ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদেশি চিন্তা-চেতনার ভালো দিকটুকু এদেশের প্রায়োগিক কলা-কৌশলে কাজে লাগাতে সদাব্যস্ত থাকেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ভাবনা তার অন্তরের গভীরে নিহিত। করোনাকালেও ড. আহমদ দেশের মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে সদাব্যস্ত থাকেন।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের বহুদর্শী কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স প্রতিষ্ঠা করা। তিনি যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটে এবং লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটে তার জন্য উদ্যোক্তা অর্থনীতি, উন্নয়ন অর্থনীতি এবং পরিবেশ ও সম্পদ অর্থনীতির উপর ডিগ্রি প্রদান করছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকের ভুল ধারণা যে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স হয়ত কোনো স্কুল। অথচ তার যোগ্য নেতৃত্বগুণে এটি অনার্স (সম্মান), পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রদান করে থাকে। তিনি সারা জীবন ধরে কিসে দেশের হিত সাধন হয় সেজন্যে সংগ্রাম করে চলেছেন। এটি করতে গিয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স ডাটাবেইজ তৈরির প্রয়াস নিয়েছেন। আবার উদ্যোক্তা অর্থনীতির জন্যে উদ্যোক্তা ইনকিউবেটর তৈরির প্রয়াস নিয়েছেন। বস্তুত শিক্ষা তার কাছে কেবল একটি সীমাবদ্ধ রেখায় সীমিত নয়- বরং বৃহত্তর পরিধিতে প্রসারমান-বাজারকেন্দ্রিক চাহিদা সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরি ড. আহমদের দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তিনি দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন। তাদের চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য তরুণ সম্প্রদায়কে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে সচেষ্ট রয়েছেন। একজন জনমানুষের অর্থনীতিবিদ হয়ে, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে তিনি বড় ভালোবাসেন। আর যেহেতু তিনি বিশ্বাস করেন যে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের ৫ কোটি লোককে উন্নত উপায়ে গড়তে হবে- সেজন্যে তার উদ্যম, উদ্যোগ, সহানুভূতি সব কিছুকে কেন্দ্র করে থাকে যুব সমাজ- এরাই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। এ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও অসাম্প্রদায়িকতার আকারে। জাতি হিসাবে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে হলে দেশে সুষ্ঠু ধারার চেতনা তৈরিতে তার আন্তরিক সম্পৃক্ততা ভালো কাজ সমাপ্ত করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তাইতো তিনি যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন সবকটিতেই যুব সমাজের আত্মিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। বস্তুত ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদের বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করলে ধারণা হয় যে, তিনি আচরণগত অর্থনীতির বাস্তবিক প্রয়োগে বদ্ধপরিকর যেখানে মনোবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক বিচার বিশ্লেষণকে একত্রে সংগঠিত করে, একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ বিশ্লেষণ ও বিচার করে কিভাবে জনগণ ও সংস্থাসমূহের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকা যায়। নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সব সময়েই মানবিক উন্নয়নে আচরণগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাস্তবতার আলোকে সুগঠিতভাবে সম্প্রসারিত করে থাকে।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ দরিদ্র পরিবারসমূহের সম্পদ বৃদ্ধি এবং তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে সক্ষমতা সৃষ্টিকল্পে ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচির মাধ্যমে একটি মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক সামগ্রিক বিকাশের পন্থা বর্তমানে কার্যকর করে যাচ্ছেন। তার সমৃদ্ধি কর্মবীর এবং এত বড় ভক্ত আমি যে, আমার দেশের বাড়ি কুমিল্লার বাগিচাগাঁওতে সমৃদ্ধি কর্মসূচিটি সুযোগ পেলে প্রচলন করতে যাচ্ছি। সমৃদ্ধি দৃষ্টিভঙ্গি দরিদ্রের সাথে কাজ করতে সহায়তা করে থাকে, যা মানবিক মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং সার্বজনীন মানবাধিকার উপভোগ করতে সহায়তা করে থাকে। ‘সমৃদ্ধি’কর্মসূচিটি বর্তমানে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এত ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির উপাদানের মিশেল রয়েছে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ যখন বিদ্যমান তখন মনে হয় এনরিচের মাধ্যমে সরকার সুবিধাভোগীদের বিতরণ ব্যবস্থায় আনতে পারেন।

আসলে সমৃদ্ধ কর্মসূচি কেবল যে যুব সমাজ নিয়ে অর্পিত হচ্ছে তা নয় বরং প্রবীণদের জন্যেও কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। এজন্যে প্রবীণদের জন্য বিশেষ কর্মসূচির যা মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক সহায়তা প্রদান করে সে জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এনরিচকে আলাদা অস্তিত্ব নির্ভর কর্মসূচির মধ্যে সুগঠিত করা প্রয়োজন। ড. খলীকুজ্জমান আহমদ পরপর তিনবার ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি হিসাবে যোগ্যতার সাথে কর্মকান্ড পরিচালনা করে সমিতিকে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদায় উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক দক্ষতার জন্য দেশ-বিদেশে সমাদৃত। জলবায়ু সম্পর্কিত তার বিশাল জ্ঞান ভান্ডার ও দক্ষতার কারণে তিনি বহু আন্তর্জাতিক ও দেশি সভা-সমাবেশ এবং সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি টেকসই উন্নয়ন তত্ত্ব এবং তার প্রায়োগিক কলা-কৌশলের জন্য, বাস্তবায়ন করতে যথাযথ অনুশীলন করতে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ দীর্ঘকাল ধরে করে যাচ্ছেন। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন যা সংক্ষেপে বিইউপি নামে পরিচিত। তিনি কুয়ালালামপুরভিত্তিক এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উন্নয়ন গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সংস্থার (এডিআইপিএ) সভাপতি এবং রোমভিত্তিক সোসাইটি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের সহ-সভাপতি ছিলেন। তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ভারতের এমটিসি গ্লোবাল পুরস্কারও অর্জন করেন। এ পর্যন্ত ৪০টির মতো গ্রন্থ এবং ৩০০ গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। পল্লী উন্নয়ন কর্মসংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, হরিজন, অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের জন্য নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। পিকেএসএফ তার অনুপ্রেরণায় অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ফ্যাইন্যান্সিং উপকারভোগীদের করা শুরু করেছে। ৭৯ বছর বয়সেও তিনি শেক্সপিয়ারের ‘এইজ এন্ড ইউথ’ কবিতার মতো প্রাণোচ্ছল, প্রচন্ড কর্মোদ্যমী এবং জীবনরসে ভরপুর। এ প্রসঙ্গে কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি-

Youth is full of pleasance, age is full of care;

Youth like summer morn, age like winter weather;

Youth like summer brave, age like winter bare

বস্তুত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ড. আহমদ এখনো ৭৯ বয়সে ২৫ এর তারুণ্যে ভরপুর। যখন তিনি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আলাপ ছলে সহজ ভাষায় অর্থনীতির জটিল সূত্রগুলো উপস্থাপন করে থাকেন, তার মধ্যে সাহিত্য প্রতিভাও রয়েছে। তার রচিত সংগীতগুলো সুন্দরভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। বোদ্ধা সংগীত পিপাসুরা তার সাহিত্য মূল্য দিয়ে থাকেন এবং সংগীত রচয়িতা হিসাবে তিনি সমাদৃত। একজন প্রাজ্ঞ সংগীত রচয়িতা হিসাবে তাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পিয়ানো বাজানোর ক্ষেত্রে সমাদৃতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। ড. আহমদ দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে বদ্ধপরিকর। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় বিশ্বাসী। তিনি ‘সাম্যভিত্তিক প্রবৃদ্ধির নীতিতে বিশ্বাসী। কখনো তিনি অহংকার করেন না। বিনয় তার স্বভাবজাত ভূষণ।

এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ: ‘সহজাতভাবে জীবনযাপন করুন, যাতে অন্যরা কেবল বাঁচতে পারে। সরলতা ও সার্বজনীনতার সারমর্ম হিসাবে সহজভাবে জীবনযাপন করুন। আমাদের কারো মধ্যে যদি খাদি চেতনা বজায় থাকে, তবে আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সরলতার সাথে নিজের উন্মেষ ঘটানো।’

নিরহংকারী অথচ কর্তব্য নিষ্ঠায় কঠোর এক মানব ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। তিনি শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম, গবেষণা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। আজকের করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে তার নীতি ও আদর্শ যেন সমুজ্জ্বল হয়ে কাজ করে থাকে। কেননা, ছাত্রছাত্রীদের গৃহে থাকতে থাকতে মানসিক বৈকল্য করোনার জন্য ধরে গেছে। আজ গবেষণার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটি দেখা দরকার। তার সৃষ্টি ও স্থাপিত ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স ইতিমধ্যে কেবল দেশে নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উদ্যোক্তা শিক্ষার সম্প্রসারণে অনন্য সাধারণ কর্মকান্ড করছে।

দেশে যেহেতু উদ্যোক্তার বিকাশ সরকার চায়, এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স পালন করতে পারে। উদ্যোক্তা উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন অসম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কারণেই উদ্যোক্তা উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন। দেশের অগ্রগতি, প্রগতি ও নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক অনুশীলনে এক বিশাল মহীরুহ ড. খলীকুজ্জমান আহমদ।

লেখক: উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, আইটি এক্সপার্ট এবং ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :