বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র

‘মেশিন নষ্ট, টেস্ট করাতে ক্লিনিকে যান’

​আল-আমিন রাজু, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ জুন ২০২১, ১৪:৩৫ | প্রকাশিত : ১৮ জুন ২০২১, ১৪:৩২

সুলভ ও সহজে চিকিৎসা সেবা নিতে বেশিরভাগ রোগীই আসেন সরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পর এদের কেউ কেউ বিপাকে পড়েন রোগ নির্ণয়ের নানা পরীক্ষায়। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ সীমিত। আবার সুযোগ থাকলেও হাসপাতালের কতিপয় অসাধু কর্মীরা রোগীকে বাইরের ল্যাব-ক্লিনিকে টেস্ট করাতে প্ররোচিত করেন।

গত তিনদিন ঢাকার শেরে বাংলা নগরের হাসপাতাল পল্লী ঘুরে বেশ কয়েকটি হাসপাতালের রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করাতে রোগীদের ভোগান্তির চিত্র দেখতে পেয়েছে ঢাকা টাইমস। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদ রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।

গত সোমবার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পাবনা থেকে বাতজ¦র ইনস্টিটিউট হাসপাতালে মনিরা খাতুন নামে এক তরুণী। বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখান। তাকে বেশ কিছু টেস্ট করাতে বলেন চিকিৎসক। ওই টেস্টগুলো হাসপাতালে করানোর সুযোগ থাকলেও সেখানকার এক কর্মী মনিরাকে বাইরের একটি নির্দিষ্ট ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা করাতে বলেন।

ঢাকা টাইমসকে মনিরা বলেন, ‘ডাক্তার দেখানোর পরপরই এক ব্যক্তি এসে নিজেকে হাসপাতালের কর্মী পরিচয় দেন। তিনি আমার ব্যবস্থাপত্র দেখে একটি ডায়াগনোস্টিক ল্যাবের ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে টেস্টগুলো সেখানে করাতে বলেন। সেখানে গিয়ে তার রেফারেন্স দিতে বলেন। কারণ হিসেবে হাসপাতালের ওই কর্মী বলেন এখানে সব মেশিন নষ্ট। ওই ল্যাবে সহজেই টেস্ট করানো যাবে।’

মনিরাকে হাসপাতাল কর্মীর দেওয়া ওই ল্যাবের খালি রিসিটের স্থিরচিত্র সংগ্রহ করেছেন ঢাকা টাইমস প্রতিবেদক। সেখানে ঢাকা ল্যাব নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। ওই রিসিট দিয়েই মনিরার মতো সেবা নিতে আসা রোগীদের ল্যাবে পাঠানো হয়। বিনিময়ে কমিশন পান হাসপাতালের অসাধু কর্মীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শেরেবাংলা নগরের সরকারি প্রায় সব হাসপাতালেই এই অসাধু চক্রটি সক্রিয়। চিকিৎসক দেখানোর পরপরই তারা অসহায় রোগীদের বাইরের ল্যাব বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে টেস্ট করতে প্ররোচিত করেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের অনেকেই ঝামেলা এড়াতে সেইসব ল্যাবে টেস্ট করাতে বাধ্য হন।

একটা সময়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে নানাভাবে প্রলোভন দিয়ে দালালরা রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার খবর শোনা যেত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দালালদের ওৎপাত অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। তবে এখন খোদ হাসপাতালের কর্মীরাই বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও প্যাথলজি প্রতিষ্ঠানে রোগীদের পাঠাচ্ছেন। নাম সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে রোগ নির্ণয় পরীক্ষায় রোগীদের ঝুঁকি থাকলেও হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা পান মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে একটি ইলেকট্রোকার্ডিয়াকগ্রাম বা ইসিজি করাতে খরচ হয় মাত্র ৮০ টাকা। একই টেস্ট বাইরের কোনো ল্যাবে করাতে গেলে লাগে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আবার রোগীর হার্টের অবস্থা সঠিকভাবে জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইকোকার্ডিওগ্রাফি টেস্ট। সরকারি হাসপাতালে এটি করতে খরচ হয় ৬০০ টাকা। একই টেস্ট বেসরকারি ল্যাব-ক্লিনিকে করাতে খরচ আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। একটি এক্সরে করাতে সরকারি হাসপাতালে করচ ১০০ টাকা কিন্তু বাইরে একই এক্সরে করাতে খরচ হয় পাঁচশ/ছয়শ টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর শের-ই বাংলা নগর এলাকার সরকারি হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড, বাবর রোড, শ্যামলী এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতোন গড়ে উঠেছে ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টার।

এ সকল প্রতিষ্ঠানে সেবার চেয়ে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসা ও টেস্টের নামে করে আসছে নানান প্রতারণা। তাদের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই সময় গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায়। জেল-জরিমানার শাস্তিও হয়। তবে হাসপাতালকেন্দ্রীক গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলোর রোগ নির্ণয় বাণিজ্য কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।

কর্তা ব্যক্তিরা যা বলছেন:

হাসপাতালে রোগ নির্ণয় মেশিন নষ্ট থাকার বিষয়ে জানতে জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কামরুন নাহার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা টাইমস। মোবাইলফোনে তিনি বলেন, তাকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে মেশিন নষ্ট থাকার কথা জানানো হয়েছে। দ্রুত ঠিক করার জন্য কাজ চলছে। তবে কতদিন ধরে নষ্ট তিনি তা জানেন না।

রোগীকে হাসপাতালের কর্মীরা নির্দিষ্ট ল্যাবের রিসিট দিয়ে পরীক্ষা করাতে পাঠাতে পারেন কিনা প্রশ্নে ডা. কামরুন নাহার বলেন, ‘রোগী কোথায় পরীক্ষা করাবে সেটা এভাবে বলে দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে কোনো রোগী পরামর্শ চাইলে সেক্ষেত্রে বলে দেওয়া ভালো। এছাড়া রোগী সিরিয়াস হলে অনেক সময় জরুরি রিপোর্টের জন্য বলা যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে নষ্ট মেশিন ঠিক করার জন্য কাজ করছি। তবে মেরামত করে তাদেরকে জনস্বার্থে দ্রুত এসে মেরামত করতে বলেছি। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

এই ধরনের অভিযোগ পাচ্ছেন জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কোনো রোগীকে রোগ নির্ণয় টেস্ট করতে নির্দিষ্ট ল্যাব বা ক্লিনিকে পাঠানোর নিয়ম নেই। আমরা সব সরকারি হাসপাতালকে এই বিষয়ে একটি নোটিশ পাঠিয়ে পরিচালকদের বলেছি তারা যেন তাদের কর্মীদের এই কাজ না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, ‘কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। আসলে চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী। তবে আমরা এসব বিষয়ে সচেতন আছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিবো।’

(ঢাকাটাইমস/১৮জুন/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :