টেকসই উন্নয়নের আলোকে শিক্ষক নিয়োগ: প্রসঙ্গ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২১, ১৭:২২

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

সম্প্রতি ১৬ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে একটি অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। নানা সমালোচনা হলেও এটির কিছু ভালো দিকও আছে-বারবার অংশীজনের মতামত নেয়া হয়েছে তাতে করে এই নীতিমালাটিinclusive ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। তবে যে বিষয়টি ওই নীতিমালা প্রণয়নে আসেনি সেটি হলো: কিভাবে পদের বিজ্ঞাপন দেয়া হবে এবং কিভাবে অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

আমরা জানি টেকসই উন্নয়ন হলো "development that meets the needs of the present without compromising the ability of future generations to meet their own needs” (United Nations General Assembly, 1987, p. 43). আমরা এটাও জানি বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন অর্জনে বিশ্ব দরবারে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পদ সৃষ্টি, বিজ্ঞাপন, নিয়োগ পরীক্ষার মতো বিষয়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিক নির্দেশনা দিতে পারতো।

যেহেতু সেই রকম দিক নির্দেশনা আমাদের নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বিভাগীয় সভাপতিরা ভয়ংকর ক্ষমতা প্রদর্শন ও অপনীতি চর্চায় নিয়োজিত সেই দূরবস্থারোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে কিভাবে টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হয় সেটা নিয়ে আমার আজকের আলোচনা। এবং এই আলোচনার প্রেক্ষাপট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ছয়জন প্রভাষক নিয়োগের বিরুদ্ধে ৮ জন শিক্ষকের প্রতিবার ও রিট পিটিশন।

দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিগত ১০ বছরে খুব ভালো ফল করে ঢাকা রাজশাহী ও চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে-উন্মুক্ত, জগন্নাথ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সহযোগী/সহকারী অধ্যাপক অনেকে হিসেবে কাজ করছে। তারা যেকোনো সময়ে অধ্যাপক হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে এখন অধ্যাপক। এমনকি একজন ছাত্রী কলা ও মানবিকী অনুষদে সর্বোচ নম্বর পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে এখন কানাডাতে পিএইচডি করছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে এম এ করে সরকারি কলেজ চাকরি করে এখন অস্ট্রেলিয়াতেই পিএইচডি করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান নতুন নিয়োগ তরুণ মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন। মেধাকে দেশ ও জাতির কাজে লাগাতে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্নভাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। সবসময়েই জ্ঞান গরিমায় নতুনরা পুরাতনদের হার মানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অপেক্ষা করি। প্রতিবছরই এখানে নিয়োগ হয় না। আবার প্রতিটি পদ তথা প্রভাষক থেকে অধ্যাপক-বিজ্ঞাপন দিতে হয়। উদ্দেশ্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে যদি কেউ যোগ্য থাকেন তার জন্য সুযোগ রাখা। এখন অবশ্য সকলেই একদিন অধ্যাপক হতে পারেন আপগ্রেডিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে-সুতরাং নতুন কেউ যাতে না আসতে পারে সেজন্য উচ্চতর পদগুলোর বিজ্ঞাপন দেয়া হয় না। আর সে কারণেই এক ধরনর স্থবিরতা বিরাজ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। পরিণতিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ে স্থান পায় না। খুব কৌশলে নিজের লোক নিয়োগ দেয়া হয় এবং মেধাবীকে বিতাড়ন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্য সকল প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। পদ শুন্য থাকলেও  নিয়োগ দেয়া বন্ধ থাকতে পারে- প্রত্যাশা আগামীতে হয়তো একজন আরও ভালো শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে। যিনি শুধু শিক্ষকই হবেন না গবেষক হবেন। এই সুযোগকে কাজ লাগিয়ে আবার মেধাবীকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ধরণের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কিছু শিক্ষক পাঠদান করবেন, কিছু শিক্ষক পাঠদান ও গবেষণা করবেন এবং কিছু শিক্ষক গবেষণা করবেন। সেখানে আছে অর্গানোগ্রাম। যদি দুটি অধ্যাপক থাকে তবে চারটি সহযোগী অধ্যাপক, ছয়টি সহকারী অধ্যাপক এবং আটটি প্রভাষক পদ থাকে।  অর্থাৎ সকলেই অধ্যাপক হতে পারেন না।

একজন শিক্ষক ৪০ বছর একটি বিভাগের থেকে মানুষ গড়বেন।  সুতরাং, কেবল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। তার আরও অনেক বিষয় দেখা হয়ে থাকে। এই অন্য বিষয় দেখাটাকে যুক্তি দিয়ে অসার প্রমাণ করা যায়। তবুও আমরা এই পদ্ধতি মেনে নিয়েছি। ভালো কিছু চাই সে আশায় আমরা অপেক্ষায় থাকি।

পদ সৃষ্টি ও বিজ্ঞাপন দেশের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ভিন্ন রকম। পদ সৃষ্টির রায় বিভাগের সকলের কাছ থেকে নেয়া হয় এবং সেটা অনুষদের সভায় উত্থাপিত হয় এবং সেখান থেকে অনুমোদিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে সুপারিশ আকারে অনুমোদিত হয়। এরপর সেটা সিন্ডিকেট পান করে। এবং চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

পদ সৃষ্টিতে এভাবে বিভাগের শিক্ষকদের সুপারিশ প্রয়োজন হলেও বিজ্ঞাপন তথা নিয়োগের সিদ্ধান্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ারম্যান নিতে পারেন। এ কারণেই এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। দর্শন বিভাগের ছয়জন অস্থায়ী প্রভাষকের নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত মাননীয় উপাচার্য নিলেও বিভাগের শিক্ষকদের কিংবা অনুষদের মতামত নেয়া হয়নি। সে কারণে এই ধরনের নিয়োগ টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী। 

আমরা মনে করি এই ৬ জন প্রভাষক নিয়োগের বিষয়টি যেভাবে ঘটছে তা টেকসই উন্নয়নের মূল নীতিগুলোকে গ্রহণ করা হয়নি। টেকসই উন্নয়ন ন্যায়পরতা, অংশীজনের মতামত, rights of future generations, deliberation, inclusive decision making নৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসবের বালাই নেই। নেই সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ন্যূনতম ছাপ।

বাংলাদেশ জাতিসংঘে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করবে। সেই অঙ্গীকারে অংশীজনের মতামতকে মর্যাদা দেবে বলে বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দর্শন বিভাগের শিক্ষকরা অনেকেই টেকসই উন্নয়নের উপর পিএইচডি করেছেন। আবার এই বিষয়ে অনেকেই প্রবন্ধ লিখেছেন। কিছুদিন আগে ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণে অংশীজনের মতামত না নেয়াতে আন্দোলন করেছেন।

সেই বিবেচনায় বিভাগের শিক্ষকরা মনে করছেন শিক্ষক নিয়োগের বেলায়ও অংশীজনের মতামত নেয়া প্রয়োজন ছিল। এখানে সরকার গৃহীত টেকসই উন্নয়ন ধারণাকে অবজ্ঞা করে সেই সনাতনী শাসন কায়েম করা হয়েছে। ফলে বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে।

কেন তড়িঘড়ি করে মাত্র ১৪ দিনের সময় দিয়ে এই মহামারীর সময়ে ৬ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা চলছে, যখন কিনা যারা নিয়োজিত আছেন তারই কাজ করতে পারছেন না? কেনই বা মাত্র ৩ দিনের নোটিশে ৫৭ আবেদনকারীর ভাইভা অনলাইনে নেয়ার হচ্ছে? এই কি তাহলে সুশাসনের নমুনা!

শিক্ষকরা আরও কিছু কারণে মনে করেন এক সঙ্গে ৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথমত বিভাগে কোনো প্রভাষকের পদ শুন্য নেই। বিভাগে যে শিক্ষক আছেন তাদের দিয়েই বিভাগ পরিচালনা করে আসছেন বর্তমান ও অতীত দুই সম্মানিত সভাপতি। যদি এখন ৬ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয় তবে তারা সহসাই স্থায়ী হতে পারবেন না। এবং তাদের স্থায়ী নিয়োগ দিতে হলে শুন্য ওই উঁচুপদগুলোকে Down Garde করতে হবে। ফলে বিতর্কিত upgradation নিয়ম অব্যাহত থাকবে এবং একদিন সকল পদ প্রভাষক পদে পরিণত হবে। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আলাদা নিয়োগ ব্যবস্থা ও অর্গানোগ্রামবিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আর এই মতের শিক্ষকরা (যারা এভাবে নিয়োগ দিচ্ছেন) বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের পরামর্শ দেন নতুন বিভাগে অধ্যাপক পদ সৃষ্টি না করতে। যাতে বর্তমানদের সুবিধা অব্যাহত থাকে। যা অনৈতিক। ব্যক্তিগতভাবে এই নীতি আমি ও আমাদের প্রতিবাদী শিক্ষকরা পছন্দ করছেন না।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা সেই উদ্দেশ্যকে ঠিক রাখতে হলে সৃষ্ট অর্গানোগ্রাম মেনে চলতে হবে। এবং যে পদ শুন্য থাকবে সেই পদের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আইনের ফাঁক গলিয়ে শুন্য পদ থাকা সত্ত্বেও Upgradation নৈতিকভাবে সঠিক হয় না। সর্বোপরি সকল শুন্য পদ এখনই পূরণ করলে আগামীতে মেধাবী ছাত্র বঞ্চিত হবে, যা টেকসই উন্নয়ন ধারণার পরিপন্থী।

বিগত ১০ বছরে দর্শন বিভাগে একটি অধ্যাপক, তিনটি সহযোগী অধ্যাপক, চারটি সহকারী অধ্যাপকের পদ শুন্য হয়েছে। এবং সেগুলো শুন্য বিবেচনা করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। বিভাগে বর্তমানে যে কজন শিক্ষক আছেন তাদের কর্মঘণ্টা হিসাব করলে কমপক্ষে ১৭৪ ঘণ্টা প্রতি সপ্তাহে। বিভাগে প্রথম পর্ব থেকে শেষ পর্ব এবং এমফিল শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে ৪০টি কোর্সের পাঠদান চলছে। প্রতিটি কোর্সের ৩ ঘণ্টা সপ্তাহে বিবেচনায় নিলে ৬০ ঘণ্টার একটি কোর্সের জন্য ২০ সপ্তাহে পাঠদান করা হলে ১২০ ঘণ্টার জনবল প্রয়োজন। সেখানে আছে ১৭৪+৫৪= ২২৮ ঘণ্টা। আর বছর ৫২ সপ্তাহ। সুতরাং অবশিষ্ট  ৫৪ ঘণ্টাও পুরো একটি সেমিস্টার অর্থাৎ ২২৮ ঘণ্টা। এভাবে গণনা করলে আর যদি সেমিস্টার সিস্টেম করা হয়, তবে আরও ৪০টি কোর্স পড়ানোর সক্ষমতা বিভাগের আছে।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে সকলেই পদ বিজ্ঞাপনের বিপক্ষে হয়তো যুক্ত হবেন। তারপরেও টেকসই উন্নয়নের জন্য আমি পদ বিজ্ঞাপনের পক্ষেই থাকছি। কারণ (১) মেধাকে মূল্যায়ন করতে হবে, (২) টেকসই উন্নয়নের আলোকে বর্তমান প্রজন্মের অধিকারকে (Rights of Present generations) মর্যাদা দিতে হবে।

সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আগেই সভাপতিকে বিভাগের শুন্যপদ বিজ্ঞাপন দিতে বলেছি। কারণ কিছু ভালো প্রার্থী আছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ৬টি প্রভাষক পদের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। যদি আগেই পদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হতো তবে আজকে যারা প্রার্থী তারা আগেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতো। পদ থাকার পরেও কেন বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি উপাচার্য ও বিভাগের সভাপতি তার জবাব দিতে পারবেন। আমার প্রশ্ন: কেন প্রভাষক পদে বিজ্ঞাপন- কেন সহকারী, সহযোগী বা অধ্যাপক পদে বিজ্ঞাপন নয়? Rights of immediate past generations কে মূল্যায়ন করতে উঁচু পদগুলোর বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তাতে ন্যায়পরতা, সুশাসন ও স্বচ্ছতা অর্জিত হবে।

একটি ঘটনাটির কথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। প্রায় বছর চারেক আগের কথা। আমার এক ছাত্রকে বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যান আমাদের বিজ্ঞ অভিভাবক অধ্যাপক শহীদুল্লাহ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়ে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটি অসাধারণ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের চেয়ে ভালো। ১০ বছর পর প্রভাষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর ওই অসাধারণ ছাত্রটি আজ বঞ্চিত হলো। আমরা মনে করতে পারি কি ওই ছাত্রটিকে বঞ্চিত করতে এই আয়োজন? আজ যে ছাত্রটি জহর লাল নেহেরু-ইন্ডিয়া থেকে এমএ করে পিএইচডি করছে, যে ছাত্রীটি কানাডাতে পিএইচডি করছে, যে ছাত্রটিকে নিয়োগ দেয়ার আনন্দ স্বেচ্ছায় আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে প্রকাশ করেন বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যান তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

সমাজে কিছু মানুষ আছে তারা সব কিছুতেই মন্দ দেখে বলেই আজ অন্যায় এর প্রতিবাদ হয়ে যায় প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র। আর সেজন্য দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হয়ে যাচ্ছে মেরুদণ্ডহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং হয়ে যাচ্ছে কল্পনাতীত স্বপ্ন।

আবার ফিরে আসি দর্শন বিভাগের নিয়োগের বিষয়ে। প্রথমত, দর্শন বিভাগের সভাপতি ও মাননীয় উপাচার্য অংশীজনের অহংবোধের মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। দ্বিতীয়ত কেবলমাত্র প্রভাষক পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উচ্চতর যোগ্যতার প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছেন। তৃতীয়ত, ছয়টি প্রভাষক পদের বিজ্ঞাপন ও নিয়োগ ভবিষৎ মেধাবীদের বঞ্চিত করবে। এটাও টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী এবং injustice। টেকসই উন্নয়ন আমাদের শিক্ষা দেয় সব কিছুর উপরে ন্যায়পরতা বা জাস্টিসকে মূল্য দিতে। এবং এই জাস্টিস অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলে।

আমরা আরও জানতে পেরেছি যে, পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিদিন একটি বোর্ডে ২০ জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে থাকে। আর সেখানে একটি unsecure মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনে ৫৭ প্রার্থীর ভাইভা নেয়া হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গত একাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এই মহামারীর সময়ে অনলাইনে পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার নীতিমালা অনুমোদন করেছে। কিন্তু তারা অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগের জন্য কোনো নীতিমালা প্রণয়ন না করে উল্টো স্রোতে সাঁতার কাটছেন। আমরা গত ৮ জুন শতাধিক শিক্ষকের ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বিষয়টি (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভা) আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে নীতিমালা প্রণয়ন করতে অনুরোধ করি যা সিদ্ধান্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা প্রতিবাদী শিক্ষকরা ইউজিসির নজরে আনলে বিজ্ঞ কমিশন ১৩ জুন ২০১২ সালে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা মনে করি ইউজিসির ওই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ও সময়পোযোগী।

এখনোও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার নীতিমালা প্রবর্তন করা করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং শিক্ষক সমিতির আহ্বানকে আমলে না নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ দর্শন বিভাগের আটজন শিক্ষকের মতামতকে উপেক্ষা করে কোনো নীতিমালা ছাড়াই মাত্র চার দিনের নোটিশে ১২ জুন ২০২১ সালে একদিনে ৫৭ জনের মৌখিক পরীক্ষা  নিয়েছেন। সুতরাং, এটা বোধগম্য যে এখানে Injustice হয়েছে। সেই injustice থেকে আবেদনকারীদের রক্ষা করতে এবং স্বচ্ছতা আনতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৮ জন শিক্ষকের আবেদনে সাড়া দিয়ে গত ১৩ জুন তারিখ অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি অভিভাবক হিসেবে ইউজিসি এখানে এক অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন।

আমরা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিবেদন করেছি এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে ইউজিসির প্রতি সম্মান রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনলাইন নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং সেই নীতিমালা অনুসরণ করে আগামী দিনের নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হোক।

আমরা মনে করি দর্শন বিভাগসহ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে টেকসই উন্নয়ন চিন্তার প্রতিফলন যেন ঘটে। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে, জাতিসংঘে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে; মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায়; বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, মাননীয় সাংসদ বৃন্দ টেকসই উন্নয়নের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি আলাদা অফিস টেকসই উন্নয়নের জন্য নিয়োজিত আছে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে, ন্যায়নীতির স্বার্থে, অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করে দেশের সকল নিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আশা করি।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, ন্যায় ও সুশাসন, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়