শিল্পী শব্দটির অবনমন ও আমাদের প্রায়োগিক জটিলতা: প্রসঙ্গ বর্তমান

নিঝুম শাহ্
 | প্রকাশিত : ২০ জুন ২০২১, ১২:৩১

আমাদের মস্তিষ্কের গঠনের জন্যই আমাদের নিউরোনগুলো তথ্যকে জেনারালাইজড করতে চায়। একই ধরনের বা প্রায় সমমানের তথ্যগুলোকে বা শব্দগুলোকে একইভাবে চিহ্নিত করে স্মৃতিতে ধরে রাখে। ফলে আমরা যে কোনো বিষয়কে জেনারালাইজড করে ফেলি। এটা যেকোনো মানুষের জিনগত সহজাত বৈশিষ্ট্য।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আশির দশকের বা আগের সময়ের কাউকে 'শিক্ষক' বললেই তাঁদের মানসপটে ভেসে ওঠে এমন একজন যিনি একটা মোটা কাঁচের ফ্রেমের চশমায় চোখ ঢেকে রাখবেন কিংবা তার বসন হবে শুভ্র ধরনের ঘিয়া, সাদা বা মোটা কাপড়ের ঢোলা পাঞ্জাবি গায়ে, একটা লাঠি নিয়ে বা ছাতা বগলে হেঁটে চলেছেন আর সকলের সাথে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করছেন এমন। সময়ের সাথে এখন আমাদের প্রজন্মের শিক্ষকের মানসপটের চিত্রায়ণ আবার বদলেছে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বা বক্তব্যের দাবিতে বলা যেতে পারে, গোয়েন্দা চরিত্র বলতেই আমাদের প্রাথমিক যে চরিত্র মাথায় খেলা করে তা হল খুবই মাসলম্যান একজন বা শারীরিকভাবে সমর্থ একজনের চেহারা। যার চোখে থাকবে বুদ্ধিদীপ্ততার ঝলক আর ক্ষুরধার দৃষ্টির প্রখরতা। চুরুট বা সিগারেটে আসক্ত, জীবনানন্দীয় শৈল্পিকতায় জড়ানো জীবন বা উদাসীন এক তুখোড় পুরুষ, যে একাই পুরো সিস্টেমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সব জটিল ধাঁধার জট ছাড়িয়ে নেয় একাই। অধিকাংশ সময়েই একজন নিরেট মাথামোটা ভক্ত বন্ধু তার সঙ্গী হয়। কিন্তু চরম বাস্তবতা এই যে, বাস্তবের গোয়েন্দারা এমন নাও হতে পারেন। তাঁদের মধ্যে উপর্যুক্ত কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকাটাই একেবারে স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমি ব্যক্তিকভাবে এখন পর্যন্ত যতজন তুখোড় গোয়েন্দার সাথে পরিচিত, তাঁদের সকলেই এর বিপরীত; শুধু বুদ্ধিদীপ্ততা আর চৌকসতা বাদ দিয়ে। ফলে আমাদের মস্তিষ্কের যে জেনারালাইজডকরণের পদ্ধতি তা অনেক তথ্য জমিয়ে রাখার জন্য ইতিবাচক পন্থা হলেও এর নেতিবাচক দিকটি হল এতে ভুল বিবেচনা হবার সম্ভাবনাও ব্যাপক। প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে চাই এর নেতিবাচক দিকটি আমরা শিল্পসাহিত্যেও হরহামেশা দেখতে পাচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন শিল্প-সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে আমরা অন্যরকম একটা শ্রদ্ধার চোখে বা সমীহের চোখে দেখতাম। একজন নাট্যকর্মী মানেই তার জন্য নিজে থেকেই একটা শ্রদ্ধা বা ভালবাসার স্রোত বয়ে যেত।

কিন্তু তিতা সত্য হচ্ছে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে পুঁজির ধাক্কায় কিছু নির্দিষ্ট মানুষের হাতে যতদ্রুত কাঁচাপয়সার আমদানি হয়েছে, তত দ্রুত তাদের রুচির পরিবর্তন হয়নি। কারণ, রুচির গতি তো বাজারের গতির মতো উর্ধবগতির নয় বরং মন্থর, কালিক স্তরে স্তরে তা মননে পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু এসব পুঁজিপতিদের এত সময় নিয়ে রুচি পরিবর্তনের সময় বা ধৈর্য কোনোটাই নেই, কারণ তারা তো সহজ ভোগে লিপ্ত।

আবার, স্বাধীনতাত্তোর সময়ে পুঁজির ধাক্কায় এবং দেশ স্বধীন হওয়ার ফল হিসেবে এদেশে হুট করে ব্যাপকহারে মধ্যবিত্তশ্রেণির উত্থান হল। ফলে যখন হুট করে একটা সমাজে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের ব্যাপক উত্থান ঘটে, তখন এই বিরাট শ্রেণির নতুন রুচির সাথে তাল মিলাতে সমাজে একটা পরিবর্তন আসে। জন্মলগ্ন থেকেই মধ্যবিত্ত একটা ফাঁপা শ্রেণি। অর্জনের চেয়ে বেশি দেখানো বা সোজাকথায় শো অফ করা ও সুযোগ সন্ধান করা, ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত থাকা এবং মোসাহেবী করে নিজের গতি করা এই শ্রেণির একটা চরমতম সহজাত বৈশিষ্ট্য। ফলে এই ফাঁপা নিরেট শ্রেণির সংখ্যাই যখন বেশি তখন তাদের এই সহমত ভাই রুচি ও পুঁজিপতিদের বিকৃত রুচির প্রভাব শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলো। সত্তর- আশি-নব্বই দশকের অসাধারণ শিল্পবোধ ধারাটি আমরা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলাম। কারণ, স্বাধীনতার পূর্বেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে ঠিক যে কাজটি পাকিস্তান করতে চেয়েছিল, রাজনৈতিক খেলায় শিল্প-সাহিত্যের জগতে পৃষ্টপোষকতার অভাবে দ্রুতই এই সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা শতভাগ রূপ পেয়েছিল।

স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্থুল রুচি শিল্প-সাহিত্যে আগ্রাসন করতে থাকল। সেখানে শিল্প-সাহিত্যের গুণাবলিকে প্রতিস্থাপন করতে থাকল রূপজ সৌন্দর্য। বাজার যখন শুধু রূপজ সৌন্দর্যে সয়লাব হল তখনই শুরু হল সস্তা লোকজনের রাতারাতি স্টার বা তারকা বনে যাওয়া। কারণ, শুধু সৌন্দর্যই যখন জনপ্রিয়তার মাপকাঠি তখন আর আলাদা করে অর্জনের কোনোকিছু থাকে না; শুধু বাহ্যিক সস্তা রূপজ সৌন্দর্য থাকলেই চলে। আলোকসজ্জা, শিল্প-সাহিত্য বা মঞ্চ সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকা মানুষটি যখন শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের বলে টিকে যায়, স্টার তকমা পেতে শুরু করে, তখন আসলে তার কাছে আমরা আলাদা করে কিছু আশা করতে পারি না। যেহেতু অন্য কোনো সাংস্কৃতিক জ্ঞান না থেকেও শুধু শারীরিক অবয়বের মাধ্যমেই নামকরা মডেল বা স্টার হওয়া যায়, তখন অনেকের ঘটেই জল থাকুক বা না থাকুক, শুধু রূপের গুণে বা নিজের টাকায় স্টার বনে যায়। ফলে এইসব নিম্নরুচিসম্পন্ন স্টাররা যখন নিজেদের 'শিল্পী' বলে পরিচয় দেন তখন শিল্পীদের যে চেহারা বা জেনারালাইজেশন মতিষ্ক করে তা আমাদের শিল্পীদের সাথে একেবারেই মিলে না। ফলে এইসব স্টারদের বা রূপজীবীদের ( ব্যক্তিকভাবে আমি তাদের রূপজীবী বলতে চাই) শিল্পী বলে প্রচারে অন্তত শিল্পীদের ভাবমূর্তি তো নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ণ হয়। ফলে, সাধারণ মানুষ শিল্পী আর রূপজীবীদের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেন মতিষ্কের জেনারালাইজেশনের ফলেই।

শাব্দিকভাবে শিল্পী শব্দটির সাথে শিল্প জড়িয়ে থাকে। কিন্তু নূন্যতম শিল্প জ্ঞান না থেকেও যারা 'শিল্পী' ( ব্যক্তিকভাবে আমি তারকা বা রূপজীবী শব্দটি ব্যবহার করতে চাই) বলে নিজেদের দাবি করেন, বা যারা অবচেতন বা চেতনভাবে তাদের 'শিল্পী' বলে আখ্যা দেন বা প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাদের প্রতিই আমার আক্ষেপ বেশি। সময় এসেছে 'শিল্পী' আর 'তারকা' বা 'রূপজীবী' শব্দের ব্যবহারের তফাত বোঝার। তাতে অন্তত যাঁরা শিল্পী তাঁরা বেঁচে যান বা তাঁদের সাধনাকে অপমান করা হয় না। নইলে মতিষ্কের জেনারালাইজেশনের ভ্রমে পরে প্রকৃত শিল্পীদের প্রতি অসম্মান এসে যায়। তখন শিল্পী বললে আমাদের মধ্যে আর শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয় না। আমাদের দেশে এই অসময়েও এখনো শিল্পের ধারাটি কিন্তু মরে যায়নি। অনেকেই এই সস্তা বাজারের ট্রলারের, জাহাজের উর্ধবগতির দিনেও প্রতিকূলে বসে নৌকা বাইছেন কষ্টে, যন্ত্রণায়। শত অভিযোগ, আক্ষেপ থাকলেও তাঁরা তাঁদের জীর্ণ জীবনে সমাজের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য শিল্পকে ধারণ করে চলেছেন অন্তরে। কারণ,যুগে যুগে শিল্প সাধনার পথে এ বাঁধা এসেছে, আসবে। এজন্যই তাঁরা শিল্পী, শিল্পের সাধক। কিছু সস্তা রূপজ তারকাদের জন্য আমি ব্যক্তিকভাবে শিল্পীদের এ অবমাননা মেনে নিতে পারি না,আহত হই, বড্ড আহত হই...।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :