আওয়ামী লীগ সহস্র বছর টিকে থাকুক বাঙালির কণ্ঠস্বর হয়ে

ইলিয়াস সানি
 | প্রকাশিত : ২২ জুন ২০২১, ১৬:৫৭

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন একটি রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে একটি বই লিখেছেন লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলছেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন।

সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ [উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।

তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোন অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান। সেখানেই ২৩শে জুন বিকালে আড়াইশো-তিন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় 'নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ', যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

নতুন দল গঠনের পর মওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করার জন্য। তিনি অন্যদের সাথে পরামর্শ করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন। সেই নতুন কমিটির সভাপতি হলে মওলানা ভাসানী। সহ-সভাপতি হলেন আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান। সাধারণ সম্পাদক হলেন শামসুল হক। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান, যার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে প্রথম সভার আয়োজন হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এভাবেই প্রথম ৪০ জনের কমিটি গঠিত হয়। (বিবিসি বাংলা)

তারপরের গল্প বাঙালি জাতিসত্তা ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানের সব অঞ্চলের মানুষকে চাঁদ-তারা খচিত পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ধর্মীয় জিকির তুলে নানা অপতৎপরতা শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে তারা পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়। ফলে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক তথা সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় পূর্ববঙ্গের ছাত্র, তরুণ, যুবক তথা সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ জানায় এবং রাজপথে নেমে আসে। তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরব প্রতিষ্ঠার দীপ্ত শপথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। কেবল মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়, তার সূত্র ধরেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়া ধর্মীয় বাতাবরণের পাকিস্তান রাষ্ট্রে অপমৃত্যু ঘটে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারী মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়।

আওয়ামী মুসলিম লীগ যেমন সংগঠনগতভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই এ আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং কারাভোগ করেন; ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। প্রথম পর্যায়ের ভাষা আন্দোলনের সভা-সমাবেশে ও মিছিল-মিটিংয়ে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেও চূড়ান্ত পর্যায় তথা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন নিরাপত্তা আইনে বন্দি। ওই সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে সুসংগঠিত রূপদানে আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও ছাত্রলীগ নেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এরপর জেলায় জেলায় সফর করে আওয়ামী লীগ নেতারা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮ টি, নেজামী ইসলাম পার্টি ১৯ টি, গণতন্ত্রী দল ১৩ টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪ টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮ টি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়। তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। তারপর আর পিছু তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগের শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিমূল ১৯৬২-এর শিক্ষা-আন্দোলনে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৯৫৫ সালের ২১,২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ কতৃক ঘোষিত ২১ দফার ১২,১৩ ও ১৪ নাম্বার দফা অনুসরণ করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে বলন। এর মাধ্যমে সর্ব সাধারণের শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের প্রথম মন্ত্রীসভা। কেন্দ্রেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ঐসময় দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় শিক্ষার বিস্তারে।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। থেমে যায় সকল শুভ উদ্যোগ। এরপর ১৯৫৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইয়ুব খান গঠিত 'জাতীয় শিক্ষা কমিশন' দৃশ্যত শিক্ষা ব্যবস্থার অভিশপ্ত এক ইতিহাস। শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আইয়ুব খানের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন। অব্যাহত আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গণি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছনে থেকে অতর্কিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। সারা দেশে পুলিশ ও ইপিআর-এর নির্যাতন ও গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব খান বাধ্য হয় শিক্ষানীতি পুনর্গঠনে।

ছেষট্টির ছয়দফা বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। মূলত দফা ছিলো একটা, বঙ্গবন্ধু একটু ঘুরিয়ে বলেছেন শুধু। এরপর ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধিকার ক্রমশ ঘনীভূত হয়। যার পূর্ণতা পায় মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনবদ্য ভূমিকার কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়।

৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর রক্তের যোগ্য উত্তরসূরী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নতুন করে গল্প লিখে। স্বৈরাচার জিয়া মাত্র ১৩ দিন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেখেছে। পরবর্তীতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে অবৈধ ভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা চালায় খালেদা জিয়া। মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ ২০০৬ সালেও অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জামাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাটকীয়তা শেষে আবারও অঘোষিত সেনা সমর্থিত সরকার। আবারও ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

সকল ষড়যন্ত্র কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাঘরিষ্ঠতা পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের কালপ্রিট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটাও করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এভাবেই আবারও শুরু হয় নতুন এক বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানের গল্প নতুন করে রুপ পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। গণমানুষের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শত বছর ধরে বাঙালির কণ্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে টিকে থাকুক।

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :