রাতের ঢাকায় পরীরা নামে- পুরুষরা ঘরে যাও

পীর হাবিবুর রহমান
 | প্রকাশিত : ২৩ জুন ২০২১, ০৮:৩৮

সামাজিক ক্লাবগুলো নিয়ে ঝড় বয়ে গেল সংসদ থেকে গণমাধ্যমে। ঢাকাই চলচ্চিত্রের খরাকবলিত সময়ে নায়িকা পরীমণি একাই কাঁপিয়ে দেওয়ার হিম্মত দেখালেন। পরীমণিকে চিনি না। ঢাকাইয়া বাণিজ্যিক ছবি দেখা হয়নি তিন দশক। সরকারের খয়রাতি সিনেমাও দেখা হয় না। তবে পরীমণির জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন আর উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরার খবর এবার বেশ রগরগে রকমে বের হয়ে এসেছে। পচা শামুকে পা কেটে সমাজের একজন সজ্জন মানুষ, সামাজিক ক্লাবের নেতৃত্বদানে ক্যারিশমাটিক সংগঠক নাসির ইউ মাহমুদ কারাগারে। পরীমণি ক্লাব বন্ধের পর গভীর রাতে ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে মাতলামি, মদের আবদার করলে বাধা দেওয়ায় নাসির ইউ মাহমুদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দেন, এটা এক পক্ষের অভিযোগ। আর পরীমণির অভিযোগ তাকে জোর করে সেখানে আটকে গলায় মদ ঢেলে দেওয়া হয়েছে, হত্যা ও ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে। পরীর কান্না নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও একটি টিভির পক্ষপাতমূলক টকশো দেখে একালের কিছু নারীবাদীকে নিয়েও সন্দেহ জাগে- আসলেই তারা নারীবাদ বোঝেন কি না। পরীর পাশে সারাক্ষণ আছেন চয়নিকা চৌধুরী। বলেছেন, পরী তার মেয়ের মতো। চয়নিকা হতে পারেন পরীর মা খালা মাসি। সেটা বিষয় নয়। পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেছিলেন, পরী প্রায় রাতেই বের হন, নানান জায়গায় যান, গন্ডগোল হয় এটা নতুন নয়। তাকে আলোচকরা আক্রমণ করলেন। অ্যাংকরও নাখোশ। শিল্পী সমিতির সভাপতি বলেছিলেন, পরী ঘটনা তাদের জানায়নি এবং তাদের প্রতিবাদ করতে বলেনি। এতেও নারীবাদী আলোচকরা নাখোশ। নারীবাদ মানে কি সরকারি আইন ক্লাবের রুলস ভঙ্গ করে গভীর রাতে যে কোনো ক্লাবে গিয়ে অশোভন স্বেচ্ছাচারী দাম্ভিক বেপরোয়া আচরণ? মাতলামি? গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাব অভিযোগ করেছে আগের রাতে সেখানে ক্লাব ও বার বন্ধের পর পরী গিয়ে হাঙ্গামা ভাঙচুর করেছেন। যে সদস্যকে ধরে অতিথি হয়ে যান তিনি শোকজ খেয়েছেন এবং পালিয়েছেন সেই অঘটনের গভীর রাতে। অন্য সদস্যরাও বাড়ির পথ ধরেছেন ইজ্জত নিয়ে। পুলিশ গিয়ে পরে পরীকে উদ্ধার করে। পরীর ফ্ল্যাটের ছবিসহ খবর এসেছে গণমাধ্যমে। বাপরে! এ যেন ফ্ল্যাট নয় মদের বার! এর সরকারি অনুমতি আছে? বা মদ খাবার রাখার লাইসেন্স? একসময় বাচ্চাদের ভূতের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো। সময় এসেছে পুরুষদেরও রাত ১১টার মধ্যে ঘরে আটকে রাখার। গভীর রাতে নষ্ট সমাজে ঢাকায় পরীরা নামে, পুরুষকে তুলে নিয়ে যায় জেল হাজতে। পাপিয়াকে যদি তার অপরাধের জন্য গ্রেফতার করা না হতো, যদি অভিজাত হোটেল থেকে কেউ অপমান করে জোর করে বের করে দিত তবে কী হতো তখন? এখন বুঝতে পারছি না। পরীর বোট ক্লাব রাতের ঘটনায় তদন্তে সত্য উদ্ঘাটন হোক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। গণমাধ্যমের দায়িত্ব মিডিয়া ট্রায়ালে তদন্ত প্রভাবিত করা নয়, সত্য উদ্ঘাটন। আর সামাজিক ক্লাব নিয়ে মনগড়া কল্পনাপ্রসূত অপপ্রচার বন্ধ হোক। পরী ভাগ্যবতী। সিনেমার বাজার শেষ হলেও তার বাজার শেষ হয়নি। বিশাল ব্যয়বহুল বিলাসী জীবন উপভোগ করছেন, গভীর রাতের ঢাকা ও বিদেশকে নিয়মিত উপভোগ করছেন। আর নারীরা দেশে মেধা-শ্রমে জীবন-জীবিকার লড়াই করছেন। একসময় বাংলা সিনেমা লিজেন্ড তৈরি করত, হলে টানত দর্শক। এখন সিনেমা নেই, দর্শক নেই, তৈরি হন কারা জানে কানাঘুষা করা মানুষেরা।

একটা মূল্যবোধের আদর্শিক সমাজ দিনে দিনে নষ্ট হতে হতে শেষ তলানিতে। সমাজের ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। একা। নিঃসঙ্গ। নষ্টরা সংগঠিত। এক অদ্ভুত আঁধার নেমেছে চারদিকে। করোনার ভয়াবহতা সামনে আগ্রাসী। উদ্বিগ্ন সরকার, নির্বিকার মানুষ। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বছরের ওপর বন্ধ। মানসিক অবসাদ স্মার্টফোনে আসক্ত ছাত্রছাত্রী। ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। করোনা কতটা থাবা দিতে পারে তা-ও না। মৃত্যুর খবর, আক্রান্তের খবর উদ্বেগজনক। এমন সময়েও মানুষের প্রতি মানুষের সমবেদনা সহানুভূতি মায়ামমতা ভালোবাসার ঘাটতি। লোক দেখানো সংস্কৃতি চালু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মানুষ ঠকানো, নিকৃষ্ট প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতা নেমকহারামি অকৃতজ্ঞতা এখন নির্লজ্জদের ডালভাত। কারও বিপদাপদে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে না। নিজেকে নিয়েই ভাবনা, নিজের হিসাব, নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত একেকজন। সমাজে কার কত প্রভাব, কার কত অর্থবিত্ত ক্ষমতা, চলছে তার অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা। সামাজিক মর্যাদা টাকায় কিনছেন কাঁচা টাকার মালিকরা। গর্ব করে বলছেনও। রাস্তায় গুলি খেয়ে মরা কুখ্যাত মুরগি মিলনরা যে সময় উচ্চশিক্ষিত নারীদের বান্ধবী হিসেবে কাছে পেয়েছে তখন থেকেই সমাজ তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এক দিনে আজকের জায়গায় আসেনি সমাজ। রুচির আকাল, আত্মমর্যাদার সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আদর্শহীন রাজনীতি, দুর্নীতি, ঘুষ, যেনতেন উপায়ে অঢেল অর্থ-বিত্ত-বৈভব কামানোর সীমাহীন লোভের নেশা সমাজকে করেছে কলুষিত। ক্যান্সারের ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তদবিরবাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য, মনোনয়নবাণিজ্য বাজিকরি সমাজ গড়েছে। সাদা কালো মিলেমিশে একাকার মুখোশের আড়ালে। কথায় সবাই ফেরেশতা। নামাজি বেড়েছে দেশে, হাজী বেড়েছে দেশে, বেড়েছে ওমরাহর সংখ্যা। বাড়েনি সৎ মানুষ, বেড়েছে দুর্নীতি। এমন কোনো পেশা নেই, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে প্রশ্ন নেই। তবু শত সীমাবদ্ধতার মাঝে গণমাধ্যমই উঁকি দেয় মানুষের হয়ে। এখানেও চরিত্রহননের ভয়ংকর খেলা চলছে। যারা তিল তিল শ্রম-মেধায় দীর্ঘ পথ হেঁটে পেশাদারির অহংকার নিয়ে উঠে এসেছেন তাদের জন্য বেদনার যে বিকৃতরা আজ আক্রমণ করে নির্লজ্জ মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে। সমাজের নানা পেশার নানা জায়গায় আড্ডা বসে। সেখানে সক্রেটিস নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের বাণী, মহাত্মা গান্ধী, উইনস্টন চার্চিলের উক্তি, আব্রাহাম লিংকনের সংগ্রাম, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর আকুতি ঠাঁই পায় না। ধান্ধা হিসেব রগরগে বিকৃত যৌনালাপে সময় গড়িয়ে যায়। গিবতে ভাসে আসর। সমাজে দিনে দিনে বেশ্যা ও তার দালালের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা। সমাজে মিশে গেছে কুৎসিত কদর্য মুখ। কে সতী কে বেশ্যা, কে বিকৃত লম্পট চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ নষ্ট সমাজ কেবল আদর্শিক রাজনীতি মূল্যবোধ ও সুশাসন রক্ষা করতে পারে। সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন, এটা কার্যকর করতে হবে। থিয়েটার এখন দর্শক টানে না, আর্ট গ্যালারি ফাঁকা থাকে। সারা দেশে কবিতা পাঠের আসর নেই, লিটল ম্যাগাজিন বের হয় না, বাউলের রাত নামে না জেলা শহরে। ফুটবল গড়ায় না মাঠে, ক্রিকেট লিগ নিয়মিত হয় না! স্কুল-কলেজে নেই খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। আছে দেশে আলেম নামধারী মোল্লাদের মনগড়া ওয়াজ। কি দুর্ভিক্ষ দেশজুড়ে। বই পড়ার নেশা কেড়েছে স্মার্টফোন। একটি ভালো বই একজন থেকে আরেকজন নেয় না, হয় না আড্ডায় পাঠ প্রতিক্রিয়ার আলোচনা। এ কোন সমাজে আমরা? বিত্তের নেশায় চিত্তের সুখ আজ নির্বাসিত! এ সমাজ বসবাসযোগ্য হয় কী করে? ভালোদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সর্বত্র মেধাহীন আজ্ঞাবহদের সিন্ডিকেট ভেঙে সৃজনশীল মেধাবীদের সামনে না আনলে এ বন্ধ্যত্ব আরও প্রকট আকার নেবে।

একসময় মানুষ রাজনীতিতে আসতেন নেশায়, মানবসেবায়, আদর্শে, দলকে ভালোবেসে। নির্লোভ নিরাভরণ সাদামাটা জীবন নিয়ে আত্মত্যাগের পথে পরীক্ষা দিতেন। এখন আসেন নিজেকে ভালোবেসে, পেশা হিসেবে নেন ক্ষমতার দাপট দেখাতে, অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে। পেশা হিসেবে নেওয়ায়, রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ফুলটাইম রাজনীতি অর্থ ক্ষমতায় ডুবে থাকেন। এখান থেকে বের করার, আদর্শিক রাজনীতিতে ফিরে আসার কোনো উদ্যোগ নেই। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতার নেশায় বুঁদ। সরকারবিরোধীরা করোনা থেকে মানুষ বাঁচানোর কথা ভুলে যেনতেনভাবে সরকার উৎখাত ও ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া। অসন্তুষ্ট জনগণের ভাষা বোঝার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কারও নেই। জনগণকে উপেক্ষা করে কোনো পথই মসৃণ নয়, কল্যাণকর নয়। আদর্শিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সুশাসন ছাড়া জনগণের কল্যাণ কারও কাছে নিরাপদ নয়। সবাই এখন থেকে ভাবতে পারেন কীভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য হয়, কীভাবে শক্তিশালী নতুন নির্বাচন কমিশন হয়। করোনার এ ভয়াবহকালে সরকার উৎখাতের নামে অস্থিরতা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা আমাদের রাজনীতিবিদদের হাতেই ক্ষমতা দেখতে চাই। সেটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, যেখানে কেউ সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে যেতে পারেন না। সরকারি কর্মকর্তা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বাড়াতে তাদের এতটাই দাপুটে করা হয়েছে যে, যেন তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে! এখান থেকে নামিয়ে নিয়ন্ত্রণে এনে বুঝিয়ে দিতে হবে জনগণ ক্ষমতার মালিক তারা সেবক। আমাদের রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই ইতিহাসের সৃষ্টি। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার স্বাধীনতা ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাস লেখা হয়েছে। আমাদের ’৬২ ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের ’৬৬-এর ছয় দফা বাঙালির জাগরণের কাল, আমাদের ’৬৯ টার্নিং পয়েন্ট। আমাদের ’৭০-এর গণরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একক নেতৃত্বের আসনে উচ্চতায় নির্ধারণ করার ইতিহাস। আমাদের রাজনীতিবিদদের হাতেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের যাত্রা ও তার অবসান। রাজনীতিবিদদের হাতেই সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। রাজনীতিবিদদের ডিঙিয়ে অর্বাচীন বালকদের হাতে পুতুল খেলার মতো বোমা গ্রেনেড হামলা, জঙ্গিবাদ, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ধারাবাহিকতার পথ রুদ্ধ। রাজনীতিবিদদেরই সেই পথ বের করতে হবে। আমাদের আদর্শিক ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে না দিলে, রাজনৈতিক বন্ধ্যত্ব না ঘুচলে রাজনীতি আরও বেশি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হবে। রাজনীতিবিদরা জাগুন, ভাবুন, সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :