আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের যাত্রায় সুন্দরতম অর্জন বাংলাদেশ

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২১, ১৩:৫৬ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২১, ১৪:০০

আপেল মাহমুদ

পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা একটা দেশকে ভিন্ন দুইটি রাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে স্বাধিকার আনতে গিয়ে জেল খেটেছেন। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ কারাগারে ৭ দিন এবং পাকিস্তান সরকারের কারগারে বাকী চার হাজার ৬৭৫ দিন। তাঁর ৫৪ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কেটেছে কারাঅন্তরীণ অবস্থায়।

দেশ ভাগের পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে উপলব্ধি করলেন মুসলিম লীগ কার্যত চাঁদ-তারা খচিত পশ্চিম পাকিস্তানের হুকুমের তাবেদার মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সেখানে নিতান্তই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যা মাত্র। গণমানুষের একটা কণ্ঠস্বর আবশ্যক।

যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তাদের সেই প্রত্যাশিত রাষ্ট্র ছিল না। শুরুতেই তাদের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, আঞ্চলিক বৈষম্য ও জাতি নিপীড়ন। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়ার মতো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র উন্মোচিত হয়। জাতীয় মুক্তি অর্জন ব্যতীত এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের যে কোনো উপায় নেই, বঙ্গবন্ধু দ্রুত তা উপলব্ধি করলেন। আর আন্দোলন-সংগ্রামের এই নবতর পর্যায়ে বেশি আবশ্যক দৃঢ়ভিত্তিসম্পন্ন সংগঠনের, এ কথাও তিনি সহজে উপলব্ধি করতে পারলেন। অধিকন্তু, বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাংগঠনিক শক্তিতে গভীর আস্থা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ৪ মাস ১৯ দিনের মাথায় প্রথমে ছাত্রলীগ এবং আরও কিছু পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম পরিকল্পিত আঘাতটাও বাঙালির কণ্ঠস্বর বরাবর। রাষ্ট্র ভাষা উর্দু ঘোষনার তীব্র প্রতিবাদটাও আওয়ামী লীগ জোরালোভাবে করতে সমর্থ হয়। শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং কারাভোগ করেন।

ভাষা আন্দোলনকে সুসংগঠিত রূপদানে আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও ছাত্রলীগ নেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এরপর জেলায় জেলায় সফর করে আওয়ামী লীগ নেতারা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।  ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে খুবই অল্প ক'দিনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রকৃতপক্ষেই বাঙালির কন্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে।

যার প্রতিফলন হিসেবে চুয়ান্নর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিশাল সংখ্যাঘরিষ্ঠতা। ১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮ টি, নেজামী ইসলাম পার্টি ১৯ টি, গণতন্ত্রী দল ১৩ টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪ টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮ টি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়। তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। আওয়ামী লীগের সুবিস্তৃতির আরও একটি পলক হলো- ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের প্রথম মন্ত্রীসভা। কেন্দ্রেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণের নাটাইটাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাতেই ছিল।  ছেষট্টির ছয় দফার মোড়কে স্বাধীনতা নামক একদফাও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক অনন্য সাধারণ প্রজ্ঞার প্রতিফলন। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তের আরও একটি নক্ষত্রসম ঘটনা। সবকিছু থরে-বিথরে মঞ্চস্থ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ হাতেই। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় যেন পৃথিবীর বুকে নবরূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশের এক বিজয় কেতন।

১৯৭১ সালের দ্রুত বয়ে যাওয়া মার্চের ঘটনাপ্রবাহ ও তারপর ৭ মার্চে, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন সৃষ্টির ঘটনাপঞ্জি যেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই বীরত্বকাব্য। অবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক বিচক্ষণতা ও দেশীয় মানুষকে উজ্জীবিত করার এক পাহাড়সম সুবিশাল জনপ্রিয়তার সুন্দর সমন্বয়ে বাংলার আকাশ বাতাসের স্বাধীনতা! সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হাত ধরে। ১৯৪৭-৭১ সালের সুদীর্ঘ ২৪ বছরের ঘটনাপ্রবাহে আওয়ামী লীগের দৃঢ়তার সবচেয়ে শুদ্ধতম ফসলের নাম বাংলাদেশ।

 

লেখক: সহ-সভাপতি, স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়