প্রেক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত

পুত্রসন্তান কামনা এবং নারীশিক্ষা

অনুবাদ: ফয়সাল খান
| আপডেট : ২৫ জুন ২০২১, ০৯:৩৪ | প্রকাশিত : ২৪ জুন ২০২১, ১২:৪৫

মূল প্রবন্ধ: এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, অধ্যাপক, উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগ, মালয় বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া; নাজিয়া মনসুর , প্রভাষক, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ডাউফিন (লন্ডন); টেরেসা রান্ডাজজো, প্রভাষক, ভেনিস সিই ফস্কারি বিশ্ববিদ্যালয়; এবং জাকি ওয়াহাজ, রিডার, অর্থনীতি বিভাগ, কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।

লিঙ্গ বৈষম্য একটি ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা বহুবিধ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংস্থা ইউনেস্কো সর্বশেষ জিইএম লিঙ্গ প্রতিবেদনে সম্প্রতি শিক্ষাক্ষেত্রে দুইটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ অসমতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এগুলো হলো: লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জনে লিঙ্গ বৈসাদৃশ্য। বিশ্বব্যাপী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার বয়সী ৩ কোটি ১০ লক্ষ মেয়েরা শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এবং তাদের অর্ধেকই কখনও স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৫ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি তরুণী একটি সম্পূর্ণ বাক্যও পড়তে সক্ষম নন। এর একটি কারণ হলো সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য। দক্ষিণ এশিয়াতে অধিকাংশ বাবা-মা শিশু জন্মের সময় একটি ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করে। এর প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে এবং শিশুর পরবর্তী জীবনের শিক্ষার হারকেও প্রভাবিত করে থাকে।

আমরা সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট জার্নালে `পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা কি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে?` শিরোনামে একটি গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সন্তান কামনার বিষয়টি মূল্যায়ন করেছি। এই মূল্যায়নের নিরিখে, এই নিবন্ধটিতে ভারত এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সন্তান কামনার ভারসাম্যহীনতার সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো পর্যবেক্ষণ করে, নারীদের শিক্ষার সাথে কতগুলো শিশু এবং কোন লিঙ্গের পছন্দ এর মধ্যে সংযোগ দেখা হয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-অসমতা বন্ধে অগ্রগতির হারের পার্থক্য

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-অসমতা বন্ধে অসাধারণ অগ্রগতি হলেও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিক্ষাকে বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে ভারতীয় সংসদ শিক্ষার অধিকার আইনটি পাস করার পরও সেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা ২০১৩ সালে অর্জিত হয়েছিল ছেলেদের অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের সাম্প্রতিক অর্জনের বিপরীতে, ১৯৯০-দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র ক্লাসরুমে মেয়েদের উপস্থিতি ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো কি ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে অতিরিক্ত কন্যাশিশু মৃত্যুর বড় পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারে?

ভারত লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে লক্ষ মেয়ে জনসংখ্যা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়েছে, মূলত কন্যাশিশুদের মধ্যে বেশি মৃত্যুহার এবং লিঙ্গ-নির্বাচনী গর্ভপাতের কারণে। বিশ্বে অতিরিক্ত মহিলাদের মৃত্যুর হার ভারতে সবচেয়ে বেশি যার হার প্রতি হাজারে ১৩.৫ পাঁচ বছরের কম বয়সী মহিলা জন্মের ক্ষেত্রে। সম্পূর্ণ বিপরীতে, এই সংখ্যাটি প্রতিবেশি বাংলাদেশে তিনেরও কম।

তবে, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে জনসংখ্যার লিঙ্গ অনুপাত আরও ভারসাম্য পূর্ণ হয়ে উঠছে এবং এটি লিঙ্গ পছন্দের পরিবর্তিত ধারার সূচক। আমাদের বিশ্লেষণগুলো দেখায় যে এটি অনেকটাই মেয়েদের লেখাপড়ায় সরকারি বিনিয়োগের সুফল।

সর্বশেষ জনসংখ্যা-বিষয়ক এবং স্বাস্থ্য জরিপ (ডিএইচএস ডেটা) বিশ্লেষণ করলেও নারীদের শিক্ষা এবং কাঙ্ক্ষিত প্রজননক্ষমতার মধ্যে ইতিবাচক সংযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই কাংখিত শিশুদের আদর্শিক সংখ্যা নিয়মিতভাবে কম সেই সব নারীদের মধ্যে যাদের প্রাথমিক-পরবর্তী পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে। তবে বাংলাদেশে, এই আকাঙ্ক্ষা উভয় লিঙ্গের সন্তানেরই, অন্যদিকে ভারতে প্রাথমিক-পরবর্তী পড়াশোনা সম্পন্ন নারীরা পুত্র সন্তান কামনার প্রতি বেশি আকাঙ্ক্ষা দেখান।

এটি কী ব্যাখ্যা করে? আমাদের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি নারীদের শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করেছে তাতে উত্তরগুলো পাওয়া যেতে পারে।

কাঙ্ক্ষিত এবং প্রকৃত প্রজননক্ষমতা নির্বাচনের বিশ্লেষণ করার জন্য ২০১৪ সালে প্রজননক্ষমতা আছে- দেশব্যাপী ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী এমন কয়েক হাজার নারীর ওপর একটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা জরিপ চালানো হয়েছিল। সেই WiLCAS 2014-এর ডাটা দিয়ে সবেমাত্র ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে আমরা দেখিয়েছি যে যদিও ‘পুত্র সন্তান কামনা’অনুযায়ী সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্তগুলো এখনও প্রভাবিত হয়, তবে বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে ‘পুত্র সন্তান কামনা’ দিন দিন কমছে।

তিন দশক আগে, বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগগুলো খুব সীমাবদ্ধ ছিল। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান কম থাকায় নারীশিশুগ্রহণের দিকে অগ্রাধিকার পরিবর্তন করার জন্য নারী শিক্ষা যথেষ্ট ছিল না। তবে ১৯৯০ সালের পর থেকে নারীদের জীবন দুইটি দিক থেকেই পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র ঐতিহাসিক পুত্র সন্তান কামনা এবং নারীদের নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ফলে নারীশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য পরিবারের উৎসাহ কম দেখায়। এর ফলে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বৃহত্তর লিঙ্গ অসমতার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়েছিল ভিন্ন পথ । সেখানে, প্রজনন অগ্রাধিকার পর্যবেক্ষিত পরিবর্তনটি ঘটার অনেক আগেই সমস্ত আর্থ-সামাজিক গ্রুপগুলোতে মেয়ে এবং ছেলেদের মধ্যে তালিকাভুক্তির ব্যবধানটি বিপরীত হয়েছিল । এর বিপরীতে, একই সময়কালে (অর্থাৎ,১৯৯০-এর দশকে), ভারতে পদ্ধতিগত লিঙ্গ ভিত্তিক শিক্ষা অসমতা, এমনকি পারিবারিক স্তরেও বহাল ছিল।

শ্রমবাজারে পরিবর্তনের ফলেও বাংলাদেশও লাভবান হয়েছে। আমরা দেখেছি যে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ ভারসাম্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল মাধ্যমিক বিদ্যালয় সম্পন্ন নারীদের পাশাপাশি সেই সব নারীদের মধ্যে যারা নারীদের বেতনভিত্তিক কাজের জন্য আরও বেশি সুযোগের ক্ষেত্র রয়েছে এমন জায়গায় বাস করেছেন, বিশেষত রমরমা তৈরি পোশাক খাত যা কয়েক মিলিয়ন তরুণ বাংলাদেশী নারীকে কাজের সুযোগ এনে দেয়।

ভারতে ভারসাম্যটির পরিবর্তন

বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ ভিত্তিক অসমতা দূর করতে ভারতের সাম্প্রতিক সাফল্য এটি ইঙ্গিত করে যে ভবিষ্যতে এই দেশটিও প্রজনন ক্ষেত্রে লিঙ্গ-বাছাইয়ের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে পরিবর্তনের পথে যেতে পারে, যা আমরা বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্য করেছি ।তবে, বাবা-মায়েদের এখনও শিক্ষাগত বিনিয়োগের বরাদ্দের ক্ষেত্রে মেয়েদের সাথে অসম আচরণ করতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমান পাওয়া গেছে যে ভারতের স্কুলে অধ্যয়নরত শিশুদের মধ্যে পরিবারের শিক্ষামূলক ব্যয়গুলিতে লিঙ্গ ভিত্তিক পক্ষপাত বৃদ্ধি পেয়েছে।

অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রমাণাদি এটাই স্পষ্ট করে যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে খুবই নেতিবাচক। বাংলাদেশের অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী দশকগুলোতে নারী শিক্ষা প্রসারে নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা উচিৎ। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে লক্ষ লক্ষ মাধ্যমিক স্কুল সম্পন্ন নারী আগামী দশকে শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করবে। তাদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করা একই সাথে জরুরি। তবে এই ধরনের মানব-বান্ধব সামাজিক বিনিয়োগ এবং নারী শিক্ষার অগ্রগতি ভারতের জনসংখ্যায় লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতার প্রভাব ফেলবে কিনা, তা এখনও তলিয়ে দেখার বিষয়।

অনুবাদ: ফয়সাল খান, অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় পরামর্শক (প্রাক্তন), ইউএনডিপি এবং ইউএনসিডিএফ বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :