স্মৃতিকথা: প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রুমা বেগম
 | প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০২১, ১৮:১৯

মাঝে মাঝে স্মৃতিতে হারাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ছোট ছোট সুখ -দুঃখ, হাসি কান্না স্মৃতিতে এসে ধরা দেয়। অনেক সুখের স্মৃতির মাঝে সামান্য দুঃখ ছিল অনার্সে ৫৯.২ শতাংশ পেয়ে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া যদিও মাস্টার্স এর সময় প্রথম শ্রেণীতে ২ য় স্থান অর্জন করে ছিলাম।

১৯৯৮ সাল। নবম শ্রেণিতে পড়ি। সবার মতো আমিও দূরন্ত শৈশব পার করছিলাম।কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে মা-বাবা সংসার নামক জটিল বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রচন্ড আগ্রহ। এসএসসি ও এইচএস সিতে স্টার মার্কসহ ভালো ফলাফল করলাম। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম।

ছোটো বেলা থেকেই কোনো গাইড লাইন ছিল না বলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন মাথায় আসেনি।তবে নাটকে হাসপাতালের নার্সদের রোগীর সেবা দেখে নার্স হতে মন চাইতো। ভালো ফলাফল করায় স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিল বউকে কষ্ট করে হলেও প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়াবে।কিন্তু যেই আমি সামান্য রক্ত দেখলেও মাথা ঘুরিয়ে যায়,সে হবে ডাক্তার!

আমিও ভর্তির সময় মোটেও লেখাপড়া করলাম না।ভাবলাম কোথাও চান্স হলে হবে না হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে কোনো এক কলেজে পড়লেই হবে।

২০০২ সাল! সিরিয়াল শেষের দিকে থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ে থাকা উদ্ভিদ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিষয়ের মধ্যে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী মৃত্তিকা চয়েস করে আসলাম।

ভর্তির দিন স্বামি খুব করে বুঝিয়ে বলল- "ইউনিভার্সিটিতে কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না এবং ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বাড়ি ফিরতে হবে।

আমার বাসা ছিল কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।ঐ সময় কোনো লাল গাড়ি ঐদিক দিয়ে আসত না। ভর্তির দিন বরকে নিয়ে ফজলুল হক হলের মধ্য দিয়ে, কালচে লাল রঙের মায়াময় কারুকার্জ কার্জন হলের শান্ত পুকুরের পাড় দিয়ে চলে আসলাম মৃত্তিকার করিডরে। ভর্তি হলাম প্রিয় ক্যাম্পাসে।

ভর্তির পর বরকে সাথে নিয়ে পুরো কার্জন হলটি ঘুরলাম।নজরে এলো প্রাণী বিজ্ঞান ছাড়া সবগুলো বিভাগ কালচে লাল রঙের।পুরো ক্যাম্পাসটিকে মনে হলো গাছপালায় ঘেরা একটুকরো শান্তির জায়গা। হাটার ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে গেল শীতল গাছের ছায়ায় প্রেমিক প্রেমিকা বা ক্যাম্পাসের সবুজ আঙিনায়

বন্ধুদের আড্ডা। প্রথম দিনের মতো বোটানিক্যাল গার্ডেনের পথ ধরে দোয়েল চত্বর থেকে বাড়ি ফেরা। তারপর থেকে শত ক্লান্তি নিয়েও কার্জন হলে প্রবেশকরা মাত্রই শান্তি শান্তি ভাব চলে আসত। রুটিনে একটা ক্লাস খুব সকালে আবার অন্যটি অনেক পরে। বরের কথা ছিল তেমন বন্ধু করা যাবে না।

প্রথম দিকেই সবাই সবার মতো বন্ধুর গ্রুপ করে নিল। সব গ্রুপেই ছেলে বন্ধু আছে। আমি প্রথমে বরের কথা মাথায় রেখে অফ টাইমে কমন রুমে গিয়ে বসে থেকে বড় আপুদের কথা শুনতাম বা সেমিনারে বসে বই পড়তাম।এরই মাঝে একদিন এক ছেলে সহপাঠী সেমিনারে এসে পাশে বসল এবং পরিচয়ের পর বলতে লাগলো আমাকে তার অনেক ভালো লাগে কিন্তু আমার যে বিয়ে হয়ে গেছে তা তো সে জানে না। কয়েকদিন পর ক্লাসের একজন আরেকদিন লাল বাস থেকে নেমে ডিপার্টমেন্টে এসে আমাকে বলছে- "রুমা তোকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়া খুব পছন্দ করে" -আমার বাসের এক বান্ধবী বলছে"।ভাইয়াও নিশ্চয়ই জানত না রুমার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।

আস্তেধীরে ভালো বন্ধুত্ব হলো কয়েকজনের সাথে। অফটাইমে আড্ডা দিতাম সিড়িকোঠায়, পুকুরের পাড়ে বা টিএসসিতে। বিকেলে ব্যবহারিক ক্লাস থাকত বলে দুপুরে প্রায়ই বন্ধু রুমি,মিতু,সোমা, জেসি,সুর্পনার সাথে চলে যেতাম রোকেয়া হলে (যদিও আমার নিজের হল ছিলো শামসুন্নাহার হল) । রোকেয়া হলে টোকেন দিয়ে সকলের সাথে পাতলা ডাল, পছন্দসই সবজি খাওয়া, কমনরুমে টিভি দেখা,শামসুন্নাহার-রোকেয়া সড়কদ্বীপে দাড়িয়ে বাদাম খাওয়া, চূড়ি কেনা, গাউছিয়ায় যেয়ে চৈতীর ড্রেস কেনা, লাচ্ছি -ফুসকা খাওয়া, সিনেমা দেখা খুব উপভোগ করতাম। এছাড়াও বরের সাথে বিভিন্ন সময়ে পহেলা বৈশাখসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানও খুব এনজয় করেছি।তাছাড়া ননমেজর ক্লাসগুলো উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ভূগোল, রসায়ন, ভূতত্ত্ব করার জন্য মোকাররম ভবন, এনেক্স ভবন দৌড়াদৌড়ি করাটাও খুব উপভোগ করতাম। সাইন্স লাইব্রেরি থেকে যে বই যে টপিকের জন্য আনতাম, দেখতাম সেই বইয়ের ঐ টপিকের পৃষ্ঠাগুলো নেই আগেই হাওয়া।

একদিন দেরিতে বই জমা দেওয়ার ৫০ পয়সা জরিমানা দিতে টিএসসি ব্যাংকে যেতে আসতে হতো ২০ টাকা দিয়ে।

এবার আসি সামান্য দুঃখের স্মৃতিতেই। পড়া পাগল বলে সকালে প্রায়ই ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই ক্লাসে চলে আসতাম। এরপর দেখতাম বাস থেকে নেমে আসা সহপাঠীদের এবং সবশেষে হলে যারা থাকত তারা ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে ক্লাস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসতে থাকত। ছোটো বেলার মতোই ইউনিভার্সিটির প্রতিদিনের লেকচার প্রতিদিন বাসায় পড়ে নিতাম। পড়ার কোনো ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করলে দু একজন ছাড়া -এখন কিসের লেখাপড়া? হেসেই উড়িয়ে দিত।

যথারীতি ১ ম বর্ষে হাতে গোনা আমরা কয়েকজন প্রথম শ্রেণিছাড়া বাকি সবাই সেকেন্ড ক্লাস।

আমার রিটেনের অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে প্রথম শ্রেনি পেলেও ব্যবহারিকে ছিল ভাইভা ৫০ এর মধ্যে ২২ যেখানে এই ধরনের নম্বর আমরা হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই ভাইবায় ৩৩-৩৬। আর ব্যবহারিক রিটেনে ১০০ এর মধ্যে পেতাম ৫৩-৫৬ বাকী সবাই ৬৬-৭২।

যাইহোক ভেবে নিলাম প্রথম বছরে বেশ কিছু নম্বর বেশি ছিল যা পরবর্তীতে কাজে লাগবে। ঠিক হলো তাই। ৩ বছর টেনে টেনে প্রায় প্রথম শ্রেণী কিন্তু যথারীতি প্র‍্যাক্টিক্যাল নম্বরে ভাইবা এবং হাতে কলমে অনেক কম নম্বর। এক বন্ধু পরামর্শ দিল শেষ বছর -" তুই তো হলে থাকিস না,আর ক্লাস শেষ হলেই চলে যাস, আর কখনো স্যারদের সাথে আলাদাভাবে দেখাও করিস না, তাই স্যাররা তোকে ভালোভাবে চিনে না" এবার স্যারদের যেয়ে একটু ব্যবহারিকের বিষয়ে বলিস।

কিন্তু ছোট বেলা হতে একটু কনজারভেটিভ ছিলাম। তাই ভাবলাম, যা হবার তাই হবে। হলো তাই।বরাবরের মতোই ব্যবহারিক নম্বর ৬০ শতাংশ কম পেয়ে ফলাফল আসলো ৫৯.২ শতাংশ পেয়ে সেকেন্ড ক্লাস। মাস্টার্সে অবশ্য ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছি। বর্তমানে এখন আমি একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক।

লেখক, রুমা বেগম, প্রভাষক, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ।

ঢাকাটাইমস/২৯জুন/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

নারীমেলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা