সাতক্ষীরা মেডিকেলে অক্সিজেন সংকটে সাতজনের মৃত্যু

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২১, ২১:০০

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
সাতক্ষীরা মেডিকেলে অক্সিজেন সংকটে মারা যাওয়া কালিগঞ্জের আকরাম হোসেন খানের ছেলে ও স্বজনরা।

সাতক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকটে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় অক্সিজেন সংকটের কারণে বুধবার সন্ধ্যা সাতটা ১০ মিনিট থেকে পৌনে ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়।
অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুবরণকারীরা হলেন- মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের করোনা রোগী সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াসিমলা গ্রামের আকরাম হোসেন খান, সিসিইউ ইউনিটে চিকিৎসাধীন শহরের ইটাগাছা এলাকার মফিজুল ইসলামের স্ত্রী খাইরুন্নেছা, শহরের কুকরালী আমতলা এলাকার মনিরুজ্জামানের স্ত্রী করোনা আক্রান্ত নাজমা খাতুন, শ্যামনগরের সোনাখালি এলাকার আশরাফ হোসেন, সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়নের বকচরা গ্রামের রবিউল ইসলাম পারভেজ, সিসিইউতে চিকিৎসাধীন দেবহাটা উপজেলার জগন্নাথপুর এলাকার আবু জাফর মো. শফিউল আলম তুহিন, সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আশাশুনির নৈকাটি এলাকার আব্দুল হামিদ।
তবে অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত।
তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সংকট দেখা দেওয়ার কথা ছিল না। সেন্ট্রাল অক্সিজেন ছাড়াও ৭০টির অধিক সিলিন্ডার আছে। অক্সিজেন সংকটে নয়, করোনায় চারজন মারা গেছে। এখানে কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- বিষয়টি খতিয়ে দেখবে প্রশাসন।
বুধবার রাত ৮টায় সরেজমিনে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের ৪র্থ তলায় আইসিইউ ইউনিট ও সিসিইউ ইউনিটের সামনে দেখা যায়, স্বজনরা আহাজারি করছেন। পর্যাপ্ত অক্সিজেন ব্যবস্থা না রাখার জন্য তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দুষছিলেন।
আইসিইউ ইউনিটে মারা যাওয়া আকরাম হোসেন খানের ছেলে তাজ মুহাম্মদ খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবা করোনা আক্রান্ত হয়ে ৪৫ দিন ধরে ভর্তি ছিলেন। কয়েকদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এর মাঝেই কয়েকদিন ধরে এই হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজিনের সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দেয়নি। সে কারণে বুধবার সন্ধ্যার পর কতগুলো রোগী মারা গেল। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে বাবাকে হারাতে হলো।
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা সাতটা থেকে অক্সিজেন নেই। রাত ৮টায় অক্সিজেন আনা হয়। এই সময়ে এই রোগীগুলো কিভাবে বাঁচবে।
তিনি আরও বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের ফোন করে ডাকা হয়েছে। আগে থেকে তাদের জানানো হলে বাবার সাথে শেষ দেখা করতে পারতাম।
এখানকার চিকিৎসকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বলেও অভিযোগ করে অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান তিনি।
শহরের মাস্টারপাড়ার ফিরোজ হোসেন জানান, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তার করোনা আক্রান্ত মেয়ে সীমা খাতুনকে বুধবার দুপুরে আইসিউতে ভর্তি করান।
তিনি জানান, বিকাল পাঁচটার দিকে সিসিইউ থেকে বের হয়ে একজন চিকিৎসক বারান্দায় অবস্থানকারী রোগীর স্বজনদের উদ্দেশ্যে বলেন, হাসপাতালে অক্সিজেন কমে আসছে। তবে দ্রুত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যদি কেউ কোন রোগী অন্যত্র নিয়ে যেতে চান, তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। সন্ধ্যা সাতটা ১০ থেকে রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত সেন্ট্রাল অক্সিজেন না থাকা অবস্থায় স্বল্প কয়েকটি সিলিন্ডারের মাধ্যমে রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এরপরও সাতজন রোগীকে মরতে হলো। তার মেয়েসহ কমপক্ষে ২০ জন রোগী আশঙ্কাজনক।
শ্রীউলা ইউনিয়নের বকচরা গ্রামের আসাদুল্লাহ জানান, গত শুক্রবার তার বড় ভাই রবিউল ইসলাম পারভেজকে মেডিকেলের ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিলেন। অক্সিজেন সংকটের কারণে সাড়ে ৭টার দিকে তার ভাই মারা যায়। এখানে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তার।
কলারোয়া উপজেলার বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও রোগীর স্বজন গোলাম মোস্তাফা বলেন, আমার স্ত্রী সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি। সিসিইউ ওয়ার্ডে অক্সিজেন বিপর্যয়ের কারণে দু’জন মারা গেছে। স্ত্রীকে আল্লাহ বাঁচিয়েছে বলে বেঁচে আছে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
কলারোয়া উপজেলার শঙ্করপুর গ্রামের জিন্নাতী খাতুন জানান, একই গ্রামের নফর আলী সরদারের ছেলে তার দুলা ভাই নাজিমউদ্দিন গত করোনা আক্রান্ত হয়ে ৪৪০ নং ওয়ার্ডের বারান্দায় গত ২৮ জুন থেকে চিকিৎসাধীন। দিনের বড় একটি সময়ে তাকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় অক্সিজেন বিপর্যয়ের কারণে তার দুলা ভাই যেভাবে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন, সেই স্মৃতি জীবদ্দশায় ভোলার নয়।
শ্যামনগর উপজেলার কাচড়াহাটি গ্রামের সাংবাদিক অনাথ মন্ডল বলেন, এক সপ্তাহ ধরে বাবাকে ৪৪০ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করে চিকিৎসা করাচ্ছি। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নেওয়া হলেও বুধবার রাত নয়টা পর্যন্ত রিপোর্ট পাইনি। সন্ধ্যা সাতটা ১০ মিনিটের পর ৩৫ মিনিট অক্সিজেন বিপর্যয় ছিল। ‘ব্যক্তিগত অক্সিজেন সিলিন্ডার না থাকলে বাবার অবস্থা কি হতো, একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন’-উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন তিনি।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ফোকালপারসন ডা. মানস কুমার মণ্ডল বলেন, বিকাল থেকে হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমের প্রেসার কমে যায়। সকালে এই বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। যশোর থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসা হয়েছে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরপরই হাসপাতালেন সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্বাভাবিক হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদাকে একাধিকার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বুধবার রাত ৯টার দিকে জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবীরের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল ফোন রিসিভ করে বলেন, স্যার ব্যস্ত রয়েছেন। পরে কথা বলুন।
(ঢাকাটাইমস/১জুলাই/এলএ/ইএস)