'জনস্বার্থের মামলা বিতর্কিত করতে মরিয়া স্বার্থান্বেষী মহল'

আমিনুল ইসলাম মল্লিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০২ জুলাই ২০২১, ১৫:৪৮ | প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০২১, ১৫:০৫

জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের কার্যক্রম সমাজের জন্য বড় অবদান রাখে। দেশের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো আদালত পাড়ায় কিছু আইনজীবী কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। এরমধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণে জনস্বার্থে ৩০০ এর বেশি মামলা করেছেন আইনজীবী মনিজল মোরসেদ। নিয়মিত আইন পেশায় থেকে জনস্বার্থের কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১৫ সালে সরকার তাকে পরিবেশ পদক প্রদান করেছে।

এই আইনজীবী প্রতিষ্ঠা করেছেন পরিবেশবাদী মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জনস্বার্থের মামলা কেন ও কী? এসব মামলা করে কতবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন, ভবিষৎতেও এ কাজগুলো নিয়মিত করতে সমস্যা হয় কি-না ইত্যাদি বিষয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা হয় মনজিল মোরসেদের। তার স্বাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ঢাকাটাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার আমিনুল ইসলাম মল্লিক

ঢাকাটাইমস: জনস্বার্থে মামলা করার চিন্তা কেন ও কিভাবে এলো?

মনজিল মোরসেদ: আইন পেশা শুরুর ২/৩ বছর পরে একদিন ঢাকা জজ কোর্ট থেকে এক আত্মীয়র বাচ্চা মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আজিমপুর রওনা হই জানাজায় অংশ নিতে। তখন ছিল কোরবানির সময়। রিকশা নিয়ে কোর্ট থেকে গুলিস্তান হয়ে বুয়েটের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

কিন্তু রাস্তায় গরুর হাটের কারণে ট্রাফিক জ্যাম থাকায় ৩ ঘণ্টার বেশি সময় লাগল পৌঁছতে। এর মধ্যে জানাজা শেষ হয়ে গেল। মনে প্রশ্ন উদয় হলো যে, আইন অনুযায়ী তো চলাচলের রাস্তা এভাবে বন্ধ করা যায় না। তবে কেন এমন হচ্ছে?

প্রতিকারের বিষয়টি মাথায় ছিল। একবার ডিসেম্বর মাসে আমার কাছে আসা এক মক্কেলের জন্য নিষেধাজ্ঞার মামলা করতে পারিনি। কারণ ডিসেম্বরে আদালত এক মাস বন্ধ থাকে। বিষয়টি আমাকে ভাবায় যে, বিচার পাওয়ার অধিকার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু কোর্ট বন্ধ, এর প্রতিকারের বিষয়টি চিন্তায় আসল। জজ কোর্টে প্র্যাকটিসের সময় এরকম অনেক বিষয়ের প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করতাম। সুযোগটা কাজে লাগালাম যখন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (এইচআরপিবি) গঠন করে কাজ শুরু করলাম। রাস্তায় গরুর হাট বন্ধ এবং ডিসেম্বর মাসে সিভিল ভ্যাকেশন কোর্ট প্রতিষ্ঠার জন্য জনস্বার্থে রিট পিটিশন দায়ের করলাম এবং রায় পক্ষে এলো।

ঢাকাটাইমস: কোন সাল থেকে জনস্বার্থ মামলা করছেন?

মনজিল মোরসেদ: ২০০৫ সালে জনস্বার্থের মামলা শুরু করি। ২০০৯ পর্যন্ত কতিপয় সিলেকটিভ জনস্বার্থের মামলা শুরু করি। যেমন আজিমপুর কবরস্থান, এতিমখানার সম্পত্তি এবং ঢাকার চার নদী রক্ষার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করি। পরবর্তী সময় সমাজের প্রত্যেক স্তরে অনিয় দুর করতে ব্যাপকভাবে এইচআরপিবির পক্ষে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করি। যার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্যে ভেজাল বন্ধ, স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা, প্রত্নতত্ত্ব এলাকা সুরক্ষা করা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠা, বিচার নিশ্চিত করা, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নির্যাতন, সিভিল রাইটস প্রতিষ্ঠা করা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, খালবিল রক্ষা করা, সরকারি সম্পত্তি রক্ষা ইত্যাদি মামলা।

ঢাকাটাইমস: সংগঠন ছাড়া এককভাবে জনস্বার্থ মামলা করা যায় কি?

মনজিল মোরসেদ: আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে কোনো জনদরদী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করছে, তাদেরকে আদালতে আসার ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রিট পিটিশন দায়ের করার সুযোগ দিয়েছেন। তবে বর্তমান অবস্থায় জনগণের কাছে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত ‘জনস্বার্থ মামলাকে’ বিতর্কিত ও অকার্যকর করার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যক্রম চলছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠির স্বার্থে জনস্বার্থমূলক মামলার হাতিয়ারকে ব্যবহার করা। স্বার্থান্বেষী মহল কৌশলে জনপ্রিয় ইস্যুকে ব্যবহার করে কোনো কোনো ব্যক্তিকে অর্থের মাধ্যমে বা আইনজীবীকে প্রভাবিত করে আদালতে পাঠাচ্ছেন। সংগঠনের ক্ষেত্রে তা অতটা সহজ নয়; কারণ সেখানে জবাবদিহিতা থাকে।

ঢাকাটাইমস: আপনাদের সংগঠন থেকে জনস্বার্থে এ যাবত কতগুলো মামলা করা হয়েছে?

মনজিল মোরসেদ: আইনজীবি হিসেবে ৩০০ টিরও বেশি জনস্বার্থের মামলা আমি ড্রাফট, ফাইলিং ও শুনানি করেছি। শুনানি শেষে ৮০টি মামলার রায় হয়েছে। যার মধ্যে ১টি মামলা চূড়ান্তভাবে আমার বিপক্ষে রায় হয়েছে। যেটি হল সুন্দরবন রক্ষার মামলা।

ঢাকাটাইমস: এযাবত কালের উল্লেখযোগ্য মামলার সারসংক্ষেপ জানতে চাই।

মনজিল মোরসেদ: অনেক মামলাই করেছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঐতিহাসিক স্থাপনা মহাস্থানগড় সংরক্ষণ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জায়গা উদ্ধার, কর্নফুলি নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, ঢাকার চার নদী দখল রোধ, লালবাগ কেল্লার জায়গা উদ্ধার, ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে ‘ফুড কোর্ট’ গঠন, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজে অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করা, নিম্ন আদালতে ডিসেম্বরের ছুটিতে দেওয়ানি অবকাশকালীন আদালত গঠন, ঢাকার রাস্তায় গরুর হাট বসানো বন্ধ, ট্যানারি শিল্পের বর্জ দিয়ে মুরগি ও মাছের খাদ্য উৎপাদন বন্ধ করা, আজিমপুর কবরস্থানের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ বন্ধ করা, দুদক আইন সংশোধন করে ক্ষমতা খর্ব করা আইন বাতিল, ষোড়শ সংশোধনী আইন বাতিল, আদালত-অবমাননার আইন সংশোধন করে কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করা আইন বাতিল নিয়ে জনস্বার্থে মামলা করেছি।

এছাড়াও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষা করা, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সি-বিচ দখল রোধ করা, সুচিত্রা সেন ও বেগম রোকেয়ার স্মৃতি সংরক্ষণ ও সম্পত্তি উদ্ধার, হাসপাতালে ইউজার ফি বৃদ্ধি রোধ, রোগীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় বন্ধ, ভিতরগড় প্রত্নতাত্তিক এলাকা সংরক্ষণের নির্দেশনা, কৃষি জমি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন, গৃহকর্মীর নিরাপত্তার আইন প্রণয়ন, নারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান বন্ধ, চট্রগ্রামর পাহাড় কাটা বন্ধ, শখীপুরের জাতীয় বন রক্ষার নির্দেশনা, সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করা, কীর্তনখোলা, কপোতাক্ষ, গোমতী, ইছামতি, মেঘনা, সন্ধ্যা, ধলেশ্বরী, মুক্তেশ্বরী, কলিঙ্গাইত্যাদি নদ-নদী ভরাট ও অবৈধ দখল বন্ধ, পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর বিচার, তুরাগ নদীসহ সকল নদ-নদীর জীবন স্বত্তা ঘোষণা, জিএমপি অনুসরণ না করে মেডিসিন উৎপাদন করা ৪৮টি মেডিসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, স্বাস্থ্যের জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর ‘ম্যালামাইন’ যুক্ত দুধ পরীক্ষা ও নিষিদ্ধ, নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধ প্রভৃতি।

ঢাকাটাইমস: জনস্বার্থ মামলা করতে গিয়ে সমস্যার সন্মুখীন হয়েছেন কতবার?

মনজিল মোরেসেদ: জনস্বার্থ রক্ষায় সকল লোভ-লালসা ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে লড়ে যাবার কারণে কতিপয় মামলায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ হলে ৩ বার আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। বাসায় কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালী অনেকে ভয়ভীতি দেখান এবং ক্ষতি করার জন্য ওৎঁপেতে আছেন।

ঢাকাটাইমস: আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ঢাকাটাইমস-এর পক্ষ থেকে অশেষ ধন্যবাদ।

মনজিল মোরসেদ: আপনাকে এবং ঢাকাটাইমস পরিবারকেও ধন্যবাদ।

(ঢাকাটাইমস/২৭জুন/এআইএম/কেআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সাক্ষাৎকার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সাক্ষাৎকার এর সর্বশেষ

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি

দাম বাড়ালে এতক্ষণে কার্যকর হয়ে যেত: ক্যাব সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন

জন্ম থেকেই নারীদের যুদ্ধ শুরু হয়: নারী উদ্যোক্তা ফরিদা আশা

নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই

ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম করা উচিত: কাউন্সিলর আবুল বাশার

তদারকি সংস্থা এবং ভবন নির্মাতাদের দায়িত্বশীল হতে হবে: অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

বেইলি রোডের আগুনে রাজউকের ঘাটতি রয়েছে: মো. আশরাফুল ইসলাম

নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ভবন অনুমোদন দিতে হবে: ইকবাল হাবিব

বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছি: আইডিআরএ চেয়ারম্যান জয়নুল বারী

ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু জঙ্গি সংগঠন মাথাচাড়া দিতে চায়

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :