শুভ জন্মদিন হায়াৎ মামুদ

পিয়াস মজিদ
| আপডেট : ০২ জুলাই ২০২১, ২০:১১ | প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০২১, ১৭:২৮

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠ্যসূচিতে স্কুলজীবনে পেয়েছিলাম একটি বই 'রবীন্দ্রনাথ: কিশোর জীবনী'। এরপর কত ভারী ভারী রবীন্দ্রজীবনী তো পড়া হলো কিন্তু হায়াৎ মামুদের মতো এমন প্রাণের রচনা আর পাই কোথা! এখনও পাঠস্মৃতি আলো করে আছে সে বইয়ের কালো অক্ষর-দল:

'ছেলেবেলায় বাবা-মা-ভাই-বোনদের স্নেহ, আদর-যত্নই আমাদের একমাত্র সম্বল, সবচেয়ে কাম্য; অথচ এই বালক তার কিছুই পাননি। রুগণা মা ছেলের কোনো খোঁজখবরই রাখতে পারেন না।

আর বাবা সর্বদাই বাইরে ঘুরে বেড়ান স্থান থেকে স্থানান্তরে, বাড়িতে আসেন যেন দুদিনের মুসাফির। বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই-বোনেরাও যে যার খেয়ালে, অথচ ১৪ ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই তো কনিষ্ঠ। তা হলে কে আছে এই শিশুর? আছে বাড়ির পুরাতন দাসদাসী। আছে তিনকড়ি দাই, কিংবা শঙ্করী, কিংবা প্যারী। তাদের পায়ে পায়ে ঘুরে, স্নেহ, তিরস্কারে দিন চলে যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ফিকে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ে বিরাট টানা বারান্দায়।

সেই স্বল্পালোকে বারান্দায় পা মেলে দিয়ে বসে উরুর উপর প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছে তারা আর নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে যে যার দেশের কথা বলাবলি করছে। তাদেরই পাশে এক কোণে চুপচাপ সুবোধ ছেলে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন হয়তো।'

এমন জীবনী পড়ে ভালবেসে উপায় না আছে একলা একা রবীন্দ্রনাথকে? আমাকে বহুজন নানা লেখকের জীবনীগ্রন্থ লেখার কথা বলেছেন কিন্তু আমি রাজি হইনি আজ পর্যন্ত কারণ হায়াৎ মামুদের 'রবীন্দ্রনাথ: কিশোর জীবনী'-র মতো ধারেকাছের কিছুই লিখতে পারবনা আমি। তথ্যের ছালবল্কল ছাপিয়ে রক্তমাংসের স্পন্দন টের পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। 'মৃত্যুচিন্তা রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জটিলতা' কিংবা 'অবহেলিত ধ্রুবপদ ও কিন্নরদল'-এর মতো বইপত্র এখনও পড়ি ফিরে ফিরে। ভাবনার অতলতা আর ভাষার জাদুময়তায় আচ্ছন্ন হই।

নজরুল নিয়ে এত এত বইয়ের মধ্যেও তো হায়াৎ মামুদ আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সম্পাদিত 'তোমার সাম্রাজ্যে যুবরাজ' সংকলনটা আলাদা করে চেনা যায়। অনন্য যেমন 'প্রতিভার খেলা নজরুল' নামে হায়াৎ মামুদের বইটাও।

এমন যে শিশুসাহিত্যের অসাধারণ সৃজন-মানুষ, তিনি তো কবিও। 'হাত ফণা তুলে রায়েরবাজার' নামে তাঁর একটি কবিতা ভীষণ প্রিয় আমার। প্রিয় তাঁর অনুবাদে 'ফাদার সিয়ের্গি', অনুবাদ কবিতা-সংকলন 'বও হাওয়া দেশান্তরী' কিংবা 'সময়ের খণ্ডচিত্র: রুশসাহিত্য'।

কী করে ভুলি 'বাংলা লেখার নিয়মকানুন' বা 'শব্দকল্পদ্রুম'? বাংলা ভাষাকে ভীতিকররূপে না, ভালবাসার বিষয় করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন তিনি। তিনি তো জানেন ' ভাষাকে ভালবাসার দুঃখ কম নয়'। 'বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই' নামে তাঁর একটা প্রবন্ধ-পুস্তকের শিরোনাম কত কথা বলে দেয় এককথাতেই!

আমরা যখন জাহাঙ্গীরনগরে ইতিহাস-এর ক্লাস করি হায়াৎ স্যার তখনও মাঝেমধ্যে প্রতিবেশী বাংলা বিভাগে ক্লাস নিতে আসতেন। দূর থেকে শুনতাম তাঁর লেকচার; লেখার মতোই কথাতেও পেতাম মণিমুক্তার স্বাদ। কবি খালেদ হোসাইন একবার বললেন স্যারের রসবোধের কথা। ভারতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেছেন শিক্ষাসফরে। ছাত্রছাত্রীরা স্থানীয় কিসমিস হাতে ইতস্তত বোধ করছিল; স্যার খাবেন কিনা-এই ভেবে।

তাদের দ্বিধা দূর করে হায়াৎ মামুদ বললেন "দাও তো। আমি পারতপক্ষে কারও দেয়া 'কিস' মিস করিনা'।

আমি নিশ্চিত আজও কোনো অচেনা মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে 'তুমি কে গো?' না বলে, স্যার চেনা কুটুমের মতো তার কুশল জানতে চাইবেন 'তা কেমন আছ গো!' বলে। আর সঙ্গে বিনা পয়সার প্রাপ্তি দিলখোলা সেই মানুষটির ভুবনভরানো হাসি তো আছেই।

তাঁর সঙ্গে আড্ডার স্মৃতি আমার সামান্যই তবে মনে আছে আমার একটি চাকুরির সাক্ষাৎকার-বোর্ডে তিনিও ছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন 'রাণুর প্রথম ভাগ' কার লেখা। আমি 'বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়' বলাতে কী যে খুশি হয়েছিলেন! বললেন "পড়ে নিও। 'কুশীপ্রাঙ্গণের চিঠি' বইটাও।"

এখন এই অবরুদ্ধ-কালে প্রায়ই মিস করি গেণ্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের সুগন্ধ-ছড়ানো তাঁর উদার-আমন্ত্রণময় বাড়িটার ভেতর-দরোজায় উৎকীর্ণ অমিয় চক্রবর্তীর জলভারাতুর পঙক্তিগুচ্ছ 'কেঁদেও পাবেনা তারে বর্ষার অজস্র জলধারে।' এই বর্ষা-থৈ থৈ মারীর কালে তিনি যেন ভাল থাকেন, আরও অনেক অক্ষরের গন্ধে আকুল করেন পাঠক-পরান।

শুভ জন্মদিন প্রিয় শব্দশিল্পী হায়াৎ মামুদ।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

ঢাকাটাইমস/২জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :