পাহাড়ে দূরত্ব কমেছে ৭০ কি.মি.

খাগড়াছড়িতে বিদেশি আদলের দৃষ্টিনন্দন সড়কটি হাতছানি দিচ্ছে

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২১, ১০:১৯

মো. ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি)

এ যেন বিদেশি কোনো দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি পথের ছবি। বাংলাদেশে এমন নয়নাভিরাম সড়ক তৈরি হবে খাগড়াছড়ির পাহাড়ে, তা আগে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। সেই কষ্টকল্পনাকেই বাস্তব রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাহাড়ের কোলে কোলে রচিত দৃষ্টিনন্দন জালিয়াপাড়া-মহালছড়ি সড়কটি এখন হাতছানি দিচ্ছে পর্যটকদের। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছে সড়কটি দেখতে।

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে দর্শনার্থীদের কাছে সবচেয়ে  আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। পার্বত্যাঞ্চলে আসা ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে বেশ পছন্দ রাঙামাটির সাজেক। তবে সেখানে যেতে ব্যবহার করতে হচ্ছে খাগড়াছড়ি সড়ক। খাগড়াছড়ি সদর হয়ে দিঘীনালা উপজেলা পাড়ি দিয়ে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক যেতে হয়।

এ ছাড়া শান্তিপুর অরণ্য কুটির, মানিকছড়ির মং রাজবাড়ি, আলুটিলা গুহা ও ঝর্ণা, দেবতা পুকুর, মায়াবিনী লেক, জেলা পরিষদ পার্ক ইত্যাদি দেশের ভ্রমণপিপাসুদের হাতছানি দিচ্ছে খাগড়াছড়িতে।

রাঙামাটির ভৌগোলিক অবস্থানগত বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের একচেটিঁয়া ব্যবসা খাগড়াছড়ি জেলা থেকে অনেকাংশ নিয়ন্ত্রিত হয়। যার বড় একটা সুযোগ করে দিয়েছে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।

খাগড়াছড়ির আরও একটি নয়নাভিরাম সড়ক বাড়তি আনন্দের মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে দর্শনার্থীদের কাছে। আর রাঙামাটি জেলা সদর ও নানিয়ারচর উপজেলার সঙ্গে নতুন মাত্রায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে যাচ্ছে এ সড়কটি।

দুর্গম এ পাহাড়ি জনপদের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষগুলো যা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি, তা বাস্তবে পরিণত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে পায়ে হেঁটে একসময়ে মহালছড়ি ও সিন্দুকছড়ি হয়ে জালিয়াপাড়া ও গুইমারা বাজারে যেতে হতো। সময়ও লাগত অনেক। কিন্তু বর্তমানে সেনাবাহিনীর আধুনিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে বদলে গেছে এ অঞ্চলের চিত্র।

জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া থেকে মহালছড়ি উপজেলার ২৪ মাইল পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এ সড়কটি নির্মাণ করেছে। এ সড়ক ব্যবহার করে ঢাকা থেকে রামগড় জালিয়াপাড়া হয়ে মহালছড়ির ২৪ মাইল এলাকা দিয়ে চালু হবে রাঙামাটির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ।

জালিয়াপাড়া-মহালছড়ি পর্যন্ত মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের ফলে ঢাকা-রাঙামাটির দূরত্ব কমবে ৭০ কিলোমিটার। আর সময়ও বাঁচবে প্রায় তিন ঘণ্টা। সড়ক যোগাযোগ ছাড়াও এই পথ রাঙামাটির নানিয়ারচর, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, গুইমারা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

ইতোমধ্যে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকাঁবাকাঁ সড়কের ভৌগোলিক অবস্থান দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে পর্যটকরা। বিশেষ করে মোটরসাইকেল যোগে নয়নাভিরাম সড়ক দেখতে সকাল থেকে সূর্যাস্থ পর্যন্ত ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।

চট্টগ্রাম থেকে দৃষ্টিনন্দন এ সড়ক দেখতে আসা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বেশ অনেক দিন ধরে খাগড়াছড়ির জালিয়াপাড়া হয়ে মহালছড়ি সড়কটির কথা ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে দেখে সড়কটি দেখার আগ্রহ জাগে। আজকে সময় করে এসেছি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকাঁবাকাঁ সড়ক দেখে মন ভরে গেছে।’

ফেনী থেকে আসা নুরু বলেন, ‘আমার এক আত্মীয়ের রাড়ি রাঙামাটি। দূরত্বের কারণে ও সময় বেশি লাগত বলে তাদের দেখতে যেতে সমস্যা হতো। রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে শুনে গতকাল তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। আজ আবার চলে যাচ্ছি। নয়নাভিরাম সড়ক যেমন দেখা হলো, আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানোও হলো।’

নিজেদের উৎপাদিত ফল-ফলাদি বাজারজাত করতে আগে বেশ সমস্যায় পড়[তেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এখন সেটি অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছে এই সড়ক। স্থানীয় ফলদ বাগানি হ্লাশিমং চৌধুরী বলেন, ‘আম, ড্রাগনসহ মিশ্র ফলদ বাগানের ফল বাজারজাত করতে আগে খুব চিন্তা হতো। এ বছর কম সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রামে ফল যাচ্ছে সিন্দুকছড়ির নতুন সড়ক ব্যবহার করে।’

চাকরিজীবী মিল্টন চাকমার বাড়ি মহালছড়ি। চাকরি করেন গুইমারা উপজেলায়। তিনি বলেন, ‘আগে খাগড়াছড়ি সদর হয়ে জালিয়াপাড়া যেতে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। এ নতুন সড়ক হওয়ায় এর দূরত্ব ২২-২৪ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। সময় ও খরচও কমেছে।’

গুইমারা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উশেপ্রু মারমা বলেন, জালিয়াপাড়া থেকে মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি সড়ক খাগড়াছড়ির দুই উপজেলাসহ এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি ছাড়াও কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত রাঙামাটির মৎস খাত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করছি। সড়কটি পূর্ণাঙ্গ চালুর অপেক্ষায় এ অঞ্চলের মানুষ।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আমজাদ হোসেন দীদার জানান, এ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক, ২৪ কিলোমিটার সাইড ড্রেন ও ৪১০ কিলোমিটার গ্রাভিটি ওয়াল, ৬৩০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল ও ৮০০ মিটার প্যালাসাইডিং নির্মাণ করা হয়েছে। এ সড়ক নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

তিনি জানান, রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামের যানজট এড়িয়ে এ সড়ক ব্যবহার করে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ চালু হলে দূরত্ব কমবে ৬৮ কিলোমিটার ও সময় বাচঁবে প্রায় তিন ঘণ্টা। প্রকল্প মেয়াদের ৬ মাস আগে কাজ শেষ করা হয়েছে বলে জানান ২০ ইসিবির অধিনায়ক।

(ঢাকাটাইমস/৫জুলাই/মোআ)