মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে দীর্ঘসূত্রতা, কনডেম সেলেই কয়েক বছর

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২১, ১১:২৪ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২১, ১২:৩৩

আমিনুল ইসলাম মল্লিক, ঢাকাটাইমস

অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। নানা অপরাধে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হন অপরাধী। বিচার প্রক্রিয়ায় যথাযথ যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতেই রায় দেন বিচারিক আদালত। কিন্তু রায় হলেই কার্যকর হয় না মৃত্যুদণ্ড। এজন্য উচ্চ আদালতের অনুমোদন এবং রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষের আপিল নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়। অথচ বাস্তবতা বলছে, এই নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতায় বাঁধা পড়ছে রায় কার্যকরের বিষয়টি। 

কারাসূত্র বলছে, গত জুন পর্যন্ত দুই হাজার ছয়জন আসামি কনডেম সেলে আছেন। যাদের রায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায়। মূলত কনডেম সেল খুবই অপ্রশস্ত একটি কক্ষ। মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে আসামিকে স্বাভাবিক কারাকক্ষ থেকে নেয়া হয় সেখানে। যেখানে খুবই কষ্টেশিষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় আসামিকে। মূলত ফাঁসির দড়িতে ঝোলার আগে কিছুদিনের জন্য ওই কক্ষে রাখা হয়। অথচ মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানার ছাড়পত্র মিলতেই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময় অপ্রশস্ত কক্ষেই থাকতে হচ্ছে আসামিকে।

আইনবিদরা বলছেন, বিচারিক আদালতের মৃত্যূদণ্ডের সাজা বাস্তবায়ন করতে হলে উচ্চ আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন। সেই অনুমোদন কতদিনে জানানো হবে বা জানতে হবে, তা আইনের কোথাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই। তা বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে দীর্ঘ সময় লাগলেও আসামি কিংবা বাদীপক্ষ কেউ কোনো আপত্তি তুলতে পারছে না। অনেকক্ষেত্রে আপরাধীর সাজা দ্রুত কার্যকর না হওয়ায় বাদীপক্ষের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে। আবার অপরাধীদের মৃত্যুর অপেক্ষায় কাটছে দীর্ঘ সময়। 

আইন অনুযায়ী, বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে পরিচিত। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র সাতদিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। আসেও তাই। আর সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। এ ছাড়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদনও করতে পারেন। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়। প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে।

নিয়ম অনুযায়ী সাতদিনের মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এলেও সেটি এবং আসামির আপিল নিষ্পত্তিতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। অনেক সময় কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হয় এজন্য। আবার হাইকোর্ট কোনো আসামির ডেথ রেফারেন্স ও অপিল নিষ্পত্তি করে রায় ঘোষণা করলেও তার পক্ষে-বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হন সংক্ষুব্ধ পক্ষ। উচ্চ আদালতে সিদ্ধান্তের এই সময়টায় কনডেম সেলে কাটাতে হয় আসামিকে। কেন এই দীর্ঘসূত্রতা? 

আইনজীবীরা বলছেন, গত দেড় বছর মহামারি করোনার কারণে উচ্চ আদালতে বিষয়গুলো নিষ্পত্তিতে সময় লাগছে। এছাড়া পর্যাপ্ত বেঞ্চ না থাকাও একটি কারণ। 

জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এসএম শাহজাহান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স বা আপিল সংক্রান্ত  মামলার সংখ্যা বাড়ছে গত দেড় বছর ধরে। কারণ সারাবিশ্বে মহামারি চলছে। কিন্তু তার আগে হাইকোর্টে দুই থেকে তিনটি বেঞ্চ থাকত ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য। মামলা শুনানি হচ্ছে, তবে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল যেন তাড়াতাড়ি শুনানি করা হয় সে ব্যাপারে নজর দেয়া উচিত। কারণ কনডেম সেলে থেকে দিনানিপাত করা কঠিন।’  

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, যথাযথ নথিপত্র তৈরি করতে একটা লম্বা সময় প্রয়োজন হয়। এটিও দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল কতদিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে সে বিষয় আইনে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। যে কারণে আসামিও ভোগান্তির শিকার, বাদীপক্ষও হতাশায় ভোগেন। তবে বিষয়টি সময়সাপেক্ষও বটে। কারণ একটি মৃত্যুদণ্ডের মামলা শুনতে হলে প্রথমেই মামলাটির পেপার বুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়। পেপারবুক তৈরি করতেই সময় লেগে যায় অনেকদিন। এমনকি কয়েক বছরও পার হয়ে যায়।’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পেপার বুক ছাপাতে হয় বাংলাদেশ সরকারের প্রেসে (বিজি প্রেস)। কিন্তু এই প্রেস পেপারবুক ছাপানোর চেয়ে অন্যান্য ছাপানোর কাজ জরুরি ভিত্তিতে করে। যেমন-জরুরি কোনো সরকারি গেজেট। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের পেপারবুক তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়।’

তিনি জানান, পেপার বুক তৈরি করতে আলাদা প্রেসের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা চেয়ে তাদের সংগঠন ২০১৬ সালে একটি রিট করে। সেই রিটের প্রেক্ষিতে রুলও দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এখন চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বিষয়টি। 

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল বিচারাধীন রয়েছে দুই হাজারের বেশি। আর শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে এক হাজার তিনশটি আপিল। কিন্তু বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য একটি বেঞ্চও নেই। ফৌজদারি মামলার বিষয়ে শুনানির জন্য বিচারপতি জেবিএম হাসানের একটি বেঞ্চ আছে। সেখানে বলা আছে, ‘অতিব জরুরি সকল প্রকার ফৌজদারি মোশন ও তৎসংক্রান্ত আবেদনপত্র গ্রহণ করিবেন।’ 

সম্প্রতি আইজি প্রিজন্স (কারা-মহাপরিদর্শক) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন সাংবাদিকদের জানান, গত ৯ জুন পর্যন্ত কনডেম সেলে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি আছেন দুই হাজার ছয়জন। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার নয়শ ৫২ ও নারী আছেন ৫৪ জন।

(ঢাকাটাইমস/৬জুলাই/এআইএম/এইচএফ)