বিলোনিয়া স্থলবন্দর উন্নয়নকাজের বড় অংশ বিএসএফের বাধায় বন্ধ

এম শরীফ ভূঞা, ফেনী
 | প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০২১, ১২:৫৭

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধায় থমকে আছে মুক্তিযুদ্ধের বহুল স্মৃতিবিজড়িত ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের এক-তৃতীয়াংশের কাজ। আগামী বছরের জুন মাসকে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হলেও উদ্বোধনের তিন বছর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি তেমন না হওয়ায় প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

দুই দেশের যৌথ সিদ্ধান্তে বন্দরের কাজ শুরু হলেও ভারত নিজে চুক্তি না মেনে আন্তর্জাতিক সীমানার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। কাজ বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী।

দেশের আমদানি-রপ্তানি গতিশীল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তবাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে দেশের ছয়টি স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ১০ একর জায়গায় প্রায় ৩৭.৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলোনিয়া স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।

উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়া পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়া স্থলবন্দরটি দেশের একমাত্র রপ্তানিমুখী বন্দর। ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে অত্যধিক সহায়ক ভূমিকা পালন করে বন্দরটি। এ বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয় ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর, রড, শুটকি, চুন ও গার্মেন্টসামগ্রী। পাশাপাশি যাত্রী পারাপার ও রাজস্ব আদায়ে এর রয়েছে অনেক সুনাম।

২০০৯ সালে ৪ অক্টোবর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিলোনিয়া স্থলবন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। বাংলাদেশের এই ১৭তম স্থলবন্দরটি বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করছে।

বিলোনিয়া শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে ৯৯ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন সিমেন্ট, পাথর, চুন, খৈল, পিভিসি ডোর, ঢেউটিন, এমএস রড, মশারি রপ্তানি করে ৬৫ লাখ ৪৩ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫২ কোটি ১৫ লাখ ৩ হাজার ৬৮৯ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৯ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন রপ্তানি পণ্যের বিপরীতে আয় হয় ৫৬ লাখ ১৪ হাজার ২২২ মার্কিন ডলার বা ৪৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩ টাকা।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বাধার মুখে পড়ে থমকে যাওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দর এরিয়া সম্প্রসারণ আর কার্যক্রম যেমন প্রসারিত হবে, তেমনি সেখানে গড়ে উঠবে কর্মসংস্থান, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের বরাদ্দকৃত প্রায় ৩৭.৪০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজগুলোর মধ্যে ছিল ওয়্যার হাউজ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড, পার্কিং-ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, ভবন নির্মাণ, ড্রেন, টয়লেট কমপ্লেক্স, ওয়েব্রিজ স্কেল, পানি সরবরাহ, বৈদ্যুতিকীকরণ, ওয়াচ টাওয়ার, ফায়ার ফাইটিল স্থাপন।

আগামী বছরের জুন মাস প্রকল্পের বাস্তবায়ন সময়সীমা। কিন্তু উদ্বোধনের তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি।

প্রথম পর্যায়ে জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় লোকদের আপত্তির মুখে পড়ে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের পরে কাজ শুরু করা হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে দফায় দফায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার মুখে পড়ে প্রকল্পটি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন বাধা-বিঘœ ডিঙিয়ে এখন পর্যন্ত কাজের প্রায় ২০ ভাগ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। প্রকল্পের নির্ধারিত স্থানের বেশ কিছু অংশ সীমান্তের ১৫০ গজের ভিতরে হওয়ায় বিএসএফের পক্ষ থেকে ওই কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা আসে। অথচ দুই দেশের যৌথ সিদ্ধান্তে বন্দরের কাজ শুরু হয়। এখন ভারত আন্তর্জাতিক সীমানার দোহাই দিচ্ছে।এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মৌখিক আলোচনা হলেও কোনো সুফল মেলেনি বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুই পক্ষের এহেন টানাপোড়েনে এখন রীতিমতো সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানায় স্থানীয়রা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন আর শ্রমিকদের মজুরি নিয়েও শঙ্কায় আছেন খোদ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল টপ লাইন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফয়সাল হায়দার এই দুই বছরের মাঝে নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় নষ্ট হতে যাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা নির্মাণসামগ্রী। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুই দেশের সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করে কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানান ঠিকাদার।

ফেনীর জায়লস্করের ১৯ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুর রহিম জানান, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার কিছু অংশ সীমান্তের দেড় শ গজের ভিতরে পড়ায় সেটি ছাড়া বাকি কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, বরাদ্দকৃত ১০ একর জায়গার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা ভেতরে পড়ায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে কাজ বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রতিউত্তরে বিজিবি থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মৌখিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। বিএসএফ তাদের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানায়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল টপ লাইনের পরিচালক ফয়সাল হায়দার বলেন, প্রকল্পের শুরু অর্থাৎ ২০১৯ সাল থেকেই সেখানে কাজ করতে বিএসএফ থেকে বাধা দেওয়া হয়। প্রকল্পের যে অংশটুকু সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতরে, এর বাইরে আড়াই একর জায়গায় কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে।

ফয়সাল হায়দার বলেন, দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশের প্রতিনিধির যৌথ সভায় দুই দেশই ১৫০ গজের ভেতরে কাজ করতে পারবে চুক্তি হলেও এই ক্ষেত্রে সেটা মানছে না তারা। ১৫০ গজের ভেতরে বরাদ্দকৃত জায়গায় নির্মাণসামগ্রী রাখা হলেও সীমান্তরক্ষীরা তা সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করেন। এভাবে কাজে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে প্রকল্পটি।

বিলোনিয়া স্থলবন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ইব্রাহিম ভূঁইয়া জানান, প্রকল্পের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভূমির অর্ধেকের বেশি সীমানা ঘেঁষা। দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা না হওয়ায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে বেগ পেতে হচ্ছে ঠিকাদারকে। ব্যবহার না হওয়ায় ও খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে অনেক টাকার নির্মাণসামগ্রী।

এদিকে বন্দরের কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও শ্রমিকরা জানান, পুরো সীমান্ত এলাকায় ভারতীয়দের বাড়িঘর থাকলেও ১৫০ গজের মধ্যে এপাড়ের মানুষদের বাগান করতে গেলেও বিএসএফে বাধার মুখে পড়তে হয়। দেড় শ গজের বাইরে গিয়ে কাজ করতে বললেও তারা (বিএসএফ) নিজেরাই তার ভিতরে কাজ করেছে বলেও জানায় স্থানীয় বাসিন্দারা।

(ঢাকাটাইমস/৬জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :