‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’

জিয়া হক
 | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০২১, ১২:১০

জ্যৈষ্ঠের স্নিগ্ধ বিকাল। ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের নিস্তব্ধ কক্ষে ঢুকতেই অব্যক্ত এক পুলক টের পেলাম। এসির শীতল বাতাসে ক্লান্তির ঘাম উবে যেতে লাগলো। চোখ পড়লো সম্ভ্রান্ত আলো ঠিকরে পড়া এক ডাগর চোখে। চেহারায় কী এক লাবণ্য। সত্তর ছুঁই ছুঁই তবুও টগবগে যুবক যেন।

নিচু কণ্ঠে সালাম দিতেই ফিরে তাকালেন। হাসপাতালের বিছানায় আধোশোয়া জাতির এক উজ্জ্বল তারকা। এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ডান হাঁটুতে অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে কদিন আগে। হাঁটু ভাঁজ করতে পারেন না। তীব্র ব্যথা। তবুও উঠে বসতে চাইছেন যেন।

দু-চারটা কথা হলো। কথায় কথায় হারানো অতীত, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নিদারুণ নিয়মে বাধা চাকরি জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ। শারীরিক দুর্বলতা মোটেও কাবু করতে পারেনি একাত্তরের এই মহান লড়াকুকে। মনে হয় সদ্য ত্রিশে পা ফেলা সাহসী যুবক। বারবার ইচ্ছে করছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই কথা বলার। মনের দ্বিধা আর কিছুটা লজ্জায় শুধু শ্রোতাই ছিলাম শেষ পর্যন্ত।

কদিন পরে এক শুক্রবার আবার হাজির ইবনে সিনা হাসপাতালে। কয়েক ঘণ্টার সাক্ষাতে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর সংগ্রামী চিত্র। চেপে রাখা ইতিহাস। একাত্তরের ভেতর-বাইরের রক্তভেজা নানান গল্প। বলা-না বলা গল্প। জানা-অজানা গল্প। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত আত্মত্যাগ, কত জীবন বিসর্জন শুনতে শুনতে এক গভীর বেদনা তৈরি হয় হৃদয়ে। একইসঙ্গে এই লড়াই, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের গল্প হৃদয়কে উৎসাহিত করে। করে দারুণ অনুপ্রাণিত।

একাত্তরে পথে পথে ওৎঁ পেতে থাকতো কত হায়েনা-হাঙ্গর। হিমালয় পাড়ি দেয়ার হিম্মত বুকে নিয়ে পার হতে হতো রক্তের দীর্ঘ নদী। নিজেদের ভেতরেও ছিল কত অজানা আতঙ্ক। কত অজানা ভয়। অজানা শত্রু। তবুও অস্ত্র হাতে আমরা মোটেও ভয় পাইনি। রক্তচক্ষুকে পরোয়া করিনি। থেমে থেমে বলতে থাকেন আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সাহসী সব পঙ্ক্তি।

একাত্তরে অনেক সুযোগসন্ধানীও ছিল। ভেতর-বাইরের চেহারায় ছিল না মিল। নারী নির্যাতনে মেতে উঠেছে অনেক মুখোশধারী। "বয় নিরবধী/ রক্তের নদী/ শকুনেরা মেলে ডানা" এমনই ভাষা ছিল তার ভয়ে শীতলপ্রায় কণ্ঠে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা পাঠ্য বইতে পড়েছি। স্যারদের মুখে ক্লাসে শুনেছি। অনেক আউট বইয়ে পড়েছি। তবুও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা যেন আমাকেই রণাঙ্গনে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। নিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্রের মুখে এক নিরীহ যুবককে। এ এক অন্য ইতিহাস। অন্য রক্তমাখা যুদ্ধ।

বহমান এই সময় নিয়ে আক্ষেপ করেন। আফসোস করেন আজকের শিশু, তরুণ ও যুবকদের নিয়ে। শোনেন একটা ঘটনা বলেই মোহমুগ্ধ গলায় বলতে থাকেন...

দরজার কড়া নড়ছে। ভেতর থেকে একজন শিশু সালাম দিলো। জানতে চাইলো কে আপনি?

—আমি অমুক...। তোমার বাবা বাসায় আছেন?

শিশুটা দরজা খুললো। মাথা নিচু করে বললো না, আঙ্কেল। আব্বু বাসায় নেই। আঙ্কেল ভেতরে আসেন?

—না না, অন্য সময়।

আব্বুকে কিছু বলতে হবে, আঙ্কেল?

—না না বলতে হবে না, ঠিক আছে।

আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল।

বাসার ছোট শিশু ও বাবার বন্ধুর সাথে কথোপকথন এটা। এটাই আদব। এটাই শিষ্টাচার। এখন কি বাচ্চারা এমন শেখে? এসব বোঝে? আমরা যে আদর্শলিপি পড়েছি, যে আদর্শ শিখেছি এই সময়ের শিশুরা কি তা শিখছে? তা ধারণ করছে?

এসব বলতে বলতে গলা ধরে এলো প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমানের। এখন একটু থামতে চাচ্ছেন বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার। দীর্ঘ দম ফেলেন। চোখ ভিজে ওঠে তার।

আমার মনে পড়লো ২০১৫ সালে মাশরাফি বিন মর্তুজা তার ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন, "আমাদের নিয়ে কিছু মোহ তৈরি হয়েছে। সেই মোহ আজ আমি ভেঙে চূর্ণ করে দিতে চাই। আমরা কিন্তু এন্টারটেইনার, বিনোদন দেয়া আমাদের কাজ। আমরা নায়ক নই। সত্যিকারের নায়ক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর লড়াকুরা। জাতির জন্য আমরা এমন কিছু আত্মত্যাগ করি না, যেটা করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমাকে ভুল বুঝবেন না। ক্রিকেটই সবকিছু নয়। আমরা শুধু চেষ্টা করে যাই এই জাতির মুখে হাসি ফোটানোর।"

সাত নং সেক্টরের সাব সেক্টরে (লাল গোলা, মুর্শিদাবাদ) অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়ানো এই বীরকে আমি বলতে পারি না—স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও দেখি লাখ লাখ বস্তিবাসী, লাখ লাখ দিনমজুর, লাখ লাখ ভাসমান মানুষ, যারা একমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার করে। হাহাকার করে সন্তানকে এক কেজি চিনি কিনে দিতে না পারার করুণ বেদনায়।

লকডাউনে অসহায় মানুষদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন করতে পারি না। চাকরি হারানো যুবকের কান্নাভেজা কণ্ঠ তাকে শোনাতে পারি না। স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক বয়সের ভারে নুয়ে পড়েও অভাবের সময় কারো থেকে কোনো সাহায্য পান না, এ সবই রয়ে যায় আমার মনের গহীনে।

জাতির এই গৌরবের অংশীদারকে বলতে পারি না, সব কর্মক্ষম মানুষ কি সম্মানজনক কাজের সংস্থান করতে পেরেছে? ফুটপাতে তাড়া খাওয়াদের কথা ভাবলেই মনে হয়, একদিকে শহরকে সুন্দর করার আয়োজন, অন্যদিকে দেখি ওই মানুষগুলোর পেছনে একটি করে নিরন্ন পরিবার। অনেকের মাথার ওপর ছাদও নেই। নেই কেউ, যাকে বলতে পারে এসব দুঃখগাঁথা।

আমরা কি নিজেরা ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে পরের তরে’ হতে পেরেছি? সব জায়গায় একটা ভাগ ভাগ ভাব। বিভক্ত জাতি এগোতে পারে কতদূর? মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আমরা এতটা বিভক্ত ছিলাম না, বলতে পারি না এসব কথাও।

স্বাধীনতা ছিল বুক ফুলিয়ে বাঁচার অবলম্বন। সবাই একসঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াবে, একসঙ্গে বাঁচবে—এই প্রতীতি নিয়ে আমাদের অভিভাবকেরা অস্ত্র ধরেছে। জীবন দিয়েছে। রক্ত দিয়েছে। সে কথা কি কোনোদিন আমরা বলতে পারবো নির্ভয়ে! ভাবতে ভাবতে আমি জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখি। মুক্ত-স্বাধীন পাখি দেখি।

হাঁটুতে ভর করে আবার দাঁড়াবেন জাতির এই সূর্যসন্তান। দৌড়াবেন অস্ত্র হাতে ইতিহাসে ভাস্বর সেই দিনগুলোর মতো। আকাশের ওই পাখির মতোই নতুন স্বপ্নের ডানা মেলবেন।

বিদায়ের আগে আগে আবার জানতে চাই, আপনার বয়স তো খুব বেশি না। হাঁটুতে এত বড় সমস্যা হলো যে দাঁড়াতেই পারেন না, অস্ত্রোপচার করতে হলো?

—বাবা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশ চষে বেড়িয়েছি। সকাল-সন্ধ্যা অবিরাম হেঁটেছি। খেয়ে না খেয়ে থেকেছি। কত কষ্ট যে করেছি! সেই সময় তো জীবনের সামান্য মায়াও করিনি। পরিবারের দিকে তাকাইনি। দীর্ঘদিন পর এখন সেই সমস্যা নতুন করে দেখা দিয়েছে।

আমার শরীর হিম হয়ে আসে। চোখ ভিজে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের কথা কানে বাজে। আবার আমি আশান্বিত হয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকি, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না!’

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :