শ্রম আইনেই উপেক্ষিত শ্রমিক

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২১, ০৮:৩৪ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২১, ১০:২২

আমিনুল ইসলাম মল্লিক, ঢাকাটাইমস

দেশের শ্রম আইন শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। এই আইনটি শ্রমিকদের জন্য অবমাননাকর। শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা এই আইনে উপেক্ষিত। আর নানা কারণে মারা গেলে শ্রমিকের পরিবার প্রতিকারও পায় না। আর এজন্য শ্রমিকের মৃত্যুর দায় শুধু মালিকেরই না, রাষ্ট্রেরও। দেশের শ্রম আইন নিয়ে এমনটাই মত আইনজ্ঞদের।

প্রতিবেশি দেশ ভারতের আইন বলছে কাজ করতে গিয়ে মারা গেলে শ্রমিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন ১০ লাখ রুপি। যেটি বাংলাদেশের টাকায় ১৫ লাখ। এর সঙ্গে আছে ইন্সুরেন্স সুবিধা ও ট্রাইব্যুনালে দেওয়ানী মামলা করার সুযোগ। সম্প্রতি দেশটির একটি কারখানায় শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ভুক্তভোগী ৯ পরিবারকে ৭৮ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে আদালত।

বাংলাদেশের ২০১৮ সালের সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী মৃত্যজনিত কারণে ভুক্তভোগী পরিবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন ২ লাখ টাকা। আর কেউ দুর্ঘটনার ফলে স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অক্ষম হলে পাবেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, কল-কারখানা বা কোনও প্রাইভেট জায়গায় শ্রমিক দিন মজুর হিসেবে কাজ করতে গেলে মালিকের পাশাপাশি শ্রমিকেরও দায়িত্বনাভূতি থাকতে হবে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেলে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারের খরচ কে চালাবে, কে তার পরিবারকে খাওয়াবে।’

তিনি বলেন, আমাদের দেশে শ্রমিক যখন কোনও রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত কলকারখানায় কাজ করতে যায় তখন শ্রম আইন ফলো করা হয়। কিন্তু কারও প্রাইভেট কাজের ক্ষেত্রে কোনো আইন নেই, এই ক্ষেত্রে আইন হওয়া দরকার।’

চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন শ্রমিকদের জন্য অবমাননাকর। এ আইন শ্রমিককে যথাযথ মূল্যয়ন করেনি। শ্রমিক তার ক্ষতিপূরণের ২ লাখ টাকা তুলতে ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হন। কিন্তু ভারতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এমপ্লয়েজ কমপেনসেশন অ্যাক্ট-১৯২৩ অনুযায়ী ১০ লাখ রুপি পায়, যা বাংলদেশে ১৫ লাখ টাকা। আবার ট্রাইবুনালে বা কোর্টে মামলা করে আরও বেশি অর্থ আদায় করতে পারেন শ্রমিক, যদি মালিকের দায়িত্বহীনতা প্রমানিত হয়।

সম্প্রতি ভারতে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দেওয়ানি মামলা করে ৯ শ্রমিকের পরিবার পেয়েছে ৭৮ লাখ রুপি। ভারতের আইনে ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় বলেন আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, এমপ্লয়েজ স্টেট ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট-১৯৪৮ অনুযায়ী বাংলাদেশেও দেওয়ানি আদালতে মামলা করা যায় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে। কিন্তু তা আদায় করতে আইনি লড়াই করতে হয় ২০-৩০ বছর।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শুক্লা সারওয়াত সিরাজ বলেন, নিমতলী, রানা প্লাজা, এফ আর টাওয়ারসহ অনেক স্থানেই অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে অনেক শিশু শ্রমিক নিহত হয়েছে। যদিও আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। শিশুদের লেবার হিসেবে কারখানাগুলো গ্রহণ করতে পারে না। নারায়নগজ্ঞের কারখানায় তালা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এখানে তালা দেয়া হবে কেন? শ্রমিকরা কি কৃতদাস? তারাতো স্বধীন মানুষ। শ্রম আইনের নির্দেশনা মানলেও এতো ক্ষতি হতো না।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণের পরিমান নতুন করে নির্ধারণ করা উচিত। গার্মেন্টস শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলার মানুষ থাকলেও সাধারণ শ্রমিকদের পক্ষে কম।গুলশানের এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি রিট করেছিলাম সংশ্লিষ্টরা এখনও আদালতে কম্প্লাই করেনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে তা অপ্রতুল। একজন শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষতিপুরণ বলতে আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী হওয়া উচিত। লস অব ইয়ার আর্নিং সাফারিং এন্ড পেইন-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ হলো নিহত শ্রমিক বেঁচে থাকলে বাকী জীবনে যা আয় করতেন সেটিসহ অন্যান্য হিসেবে করে ক্ষতি পুরণ নির্ধারণ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার কারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ড সহ নানা দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিক মারা যাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগির পরিবার। কারণ আইনের বিভিন্ন জটিলতায় ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে শেষ পর্যন্ত দমিয়ে যান গরীব ভুক্তভোগিরা। তাসরিন ফ্যাশান্স, রানাপ্লাজা, এফআর টাওয়ার, তুবা ফ্যাশন্স এসব দুর্ঘটনার অন্যতম।

উচ্চআদালতের পর্যবেক্ষণ

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় শ্রমিক নিহতের ঘটনায় বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক মন্তব্যে বলেন, ‘চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দায় রাষ্ট্রের কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। নিমতলীর ঘটনার পর কমিটির সুপারিশ মেনে আন্তরিক হলে এই ঘটনা ঘটত না, এটা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা।

হাইকোর্ট আরও বলেন, আগুনে মানুষ পুড়ে মরে তাহলে সিটি কর্পোরেশন কী করে? শুধু আন্তরিক হলে হবে না। কাজ করতে হবে। নিমতলীর ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির যে সুপারিশ ছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। নিমতলীর আগুনের ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী দুই বোনকে দত্তক (ভরণপোষণ) নিয়েছিলেন। উনি তো (প্রধানমন্ত্রী) একা দেশ চালাতে পারবেন না। এই যে সুপারিশ, এগুলো তো বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্ব।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগে। এতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী প্রাণ হারিয়েছেন। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মোহাম্মদ আবুল হাসেম সহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে চারদিনের রিমাণ্ডে পেয়েছে পুলিশ।

(ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/ডিএম)