কোরবানির অর্থনীতি

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০২১, ১৪:০৩ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২১, ১৪:০৫

তৌহিদ এলাহী

অতি সামান্য অর্থনীতির জ্ঞান দিয়ে যা বুঝি বাজারে টাকা বা মুদ্রার ফলপ্রসূ কন্ট্রিবিউশন মাপার জন্য দেখা হয় মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্টকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকা হাতবদল হয়ে ঘুরতে থাকে- যত বেশি হাতবদল হবে অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, খরচ হবে,  আরেকজন পাবে- এভাবেই অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

কোনো এক বড় ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ বা কালোটাকার মালিক যদি টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়, তাহলে মাল্টিপ্লাইয়ার  ইফেক্ট বন্ধ অথবা ধীর হয়ে যায়। অপরদিকে ঈদ, পয়লা বৈশাখ,  গ্রামকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কৃষক, ব্যবসায়ীর  ইনকাম, সরকারের সোশ্যাল সেফটি নেট এর টাকাগুলো অনেক বেশি হাতবদল হয়, অর্থনীতিকে প্রাণদান করে। এই ধরুন সামান্য গরু পালনের সাথে জড়িত ঘাস, এনিমেল ফিড, দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবসায়ী,  চামড়া ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা, ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক, দালাল/কসাই,  রাখাল, দোকানদার কত নাম জানা অজানা পেশার কতজন যে জড়িত তা আঙুল গুনে হিসাব করা সম্ভব নয়। এরা যা পায় তা দিয়ে চালু রাখে গ্রামের চাল, ডাল, কাপড় ও নাম অজানা কত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবন। এই ধরুন কোরবানিকে কেন্দ্র করে দেশে ফ্রিজের যে ব্যবসা হয় এটা আপনি ফেলে দিতে পারবেন না। এই ঈদকে কেন্দ্র করে এভাবেই টাকা ফ্লাই করে, মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট কাজ করে। আমাদের কোরবানির অর্থনীতির পরিমাণ প্রায় ৭০-৮০ হাজার কোটি হলেও এর মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট অনেক বেশিগুণ। দেশের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ১০০ কোটি  ডলার ছাড়িয়েছে তা এই কোরবানি ঈদের অবদান।

 

দেশ স্বাধীনের পর যে কয়টি যুগান্তকারী পলিসি ডিসিশন হয়ে হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আশির দশকে দেশের ওষুধনীতি (দেশে এভেইলবল ওষুধ আমদানি নিষিদ্ধ করা), সহজশর্তে গার্মেন্টের জন্য এলসি করার সুযোগ এবং সর্বশেষ দেশে বিদেশি গরু আমদানি নিষিদ্ধ করা। এগুলোর প্রত্যেকটার টাকাগুলোর ফ্লাইং স্পেস দেখাতে গেলে বিরাট মহাকাব্য হয়ে যাবে। ঋণদাতাদের জিডিপি বা জিএনপির হিসাব, বিরাট বুদ্ধিজীবী অর্থনীতিবিদদের পত্রিকার রিপোর্ট শেষের কমেন্টারি বা মাঝের পাতার কলাম কিংবা আধুনিক সেকুলার ও ভেজিটেরিয়ান বুদ্ধিজীবীদের পশুপ্রেম এ নিয়ে আপনাকে কোনো ধারণা দিতে পারবে না। এ জানতে হলে আপনাকে এ সেক্টরগুলোর সাথে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষের সাথে মিশতে হবে, তাদের জীবন-জীবিকা দেখতে হবে, বেঁচে থাকার সংগ্রাম উপলব্ধি করতে হবে, দিনশেষে তাদের দু বেলা ভাতের সংস্থানের পর ক্যাপ্সটান সিগারেট বা আকিজ বিড়ি টানার সুখ সন্ধান করতে হবে। আর নতুন পলিসিতে উৎসাহিত হয়ে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ,  বেকার যুবক থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারাও পশুপালনের দিকে ঝুঁকেছে, তাদের ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু এ কোরবানির ঈদ। দেশে কমবেশি আট কোটি লোক এ শিল্পের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপকারভোগী।

এসব বলার উদ্দেশ্য হলো লকডাউন শিথিল জাস্টিফাই করা। আসলে এসময় যারা লকডাউন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন,  তারা হয়তো কোনোদিন গ্রামে জাননি অথবা গেলেও গ্রামের মানু্ষের জীবন ও জীবিকার উৎস সন্ধান করেননি। আপনি অর্থনীতির কোন থিউরিতে এ লকডাউন জাস্টিফাই করবেন?

 

ধান ভানতে গিয়ে আরেকটু শিবের সংগীত পরিবেশন করি,  কোরবানির গরু জবাই নিয়ে কিছু সিজনাল পশুপ্রেমীর আবির্ভাব হয়। দয়া করে কোরবানির ছাগলের মতো অসময়ে ভ্যা ভ্যা করবেন না। মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিন। এক কৌটা দই খেয়ে কি পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া হত্যা করেছেন জানলে আপনার ভ্যা ভ্যা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর