ডেঙ্গু জ্বরে চাই সচেতনতা

রবিউন নাহার তমা
 | প্রকাশিত : ১৮ জুলাই ২০২১, ১৯:৫৯

দেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে করোনার সংক্রমণ। নানারকম বিধিনিষেধ কিংবা লকডাউন কোনোটিই থামাতে পারছে না করোনার ঊর্ধ্বগতি। এরই মধ্যে নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে 'ডেঙ্গু জ্বর'। ২০১৯ সালের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ না করলেও প্রতিদিনই হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে গত একমাসে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গু প্রায় ছড়ায়নি বললেই চলে। বরং রাজধানী ঢাকাতেই এর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।

দুশ্চিন্তার বিষয় হলো এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা আনুপাতিকহারে বেড়েছে। একটি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঢাকার এক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পাঁচশজন রোগীর মধ্যে দুশোজনের বেশিই শিশু বলে জানা যায়। এর মধ্যে কয়েকজন আইসিইউতে আছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এসব শিশুর বেশিরভাগেরই বয়স আট থেকে ১৬ এর মধ্যে। জরিপ বলছে, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীর পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি রোগী শুধু মাত্র যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকার। অপরিছন্নতা এবং অসচেতনতা এর মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা যেমন একদিকে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে অন্যদিকে আবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তাই অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে যে, কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গুজ্বর একসাথে হয় কি না। এ প্রসঙ্গে স্বনামধন্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বর এবং কোভিড-১৯ দুটোই ভাইরাসজনিত রোগ হলেও দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। একজন রোগী কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু জ্বরে একসাথে আক্রান্ত হতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই জ্বর, গলা ব্যথা, সর্দি, কাশি এবং স্বাদ না থাকা হতে পারে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে এসব লক্ষণের সাথে নাকে ঘ্রাণ পাওয়া যায় না এবং কারো কারো পাতলা পায়খানা হয়। এছাড়া শ্বাসকষ্ট-জনিত সমস্যা হতে পারে, যেটি ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে হয় না।

ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে চার-পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল অ্যালার্জির মতো র‍্যাশ হতে পারে। তখন রক্তে প্ল্যাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট (বা রক্তের অনুচক্রিকা) এর সংখ্যা জানা খুবই জরুরি। কেননা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্লাটিলেট খুব দ্রুত কমে যায়। যেমন-আজকে একজন রোগীর প্লাটিলেট ১৪২০০০ হলে পরের দিনই তা ৪২০০০ এ নেমে যেতে পারে। প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। মানুষের রক্তে স্বাভাবিকভাবে প্লাটিলেটের পরিমাণ প্রতি ঘন মিমিতে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। নানা কারণেই এর সংখ্যা কমে আসতে পারে, আর তখন রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তির ‘শক সিন্ড্রোম’ হতে পারে। এর কারণে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। কিছু লক্ষণ যেমন-যদি দেখা যায় যে রোগীর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে অথবা তার কালো পায়খানা হচ্ছে তখন রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন-নাক বা দাঁতের মাড়িতে রক্তপাত, প্রস্রাব অথবা মলের সঙ্গে রক্তপাত, ক্ষতস্থান না শুকানো এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণ, মাত্রাতিরিক্ত র‍্যাশ ইত্যাদি প্লাটিনেট কমে যাওয়ার উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্লাটিলেট যদি ৫০০০-এর কম হয় তখন ব্রেন, কিডনি, হার্টের মধ্য রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে অনেকটাই আশার কথা এই যে এমন পরিস্থিতে পড়া রোগীর সংখ্যা খুবই কম। বারডেম হাসপাতালের মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমউদ্দিন বলেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমার সঙ্গে অন্য অনেক (অন্তত আরও এগারটা) কারণে রক্তক্ষরণ হয়। বরং প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ দিতে পারলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাসাতেই সম্ভব। তাছাড়া রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে পারলে ডেঙ্গু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।

এডিস মশাকে বলা হয় 'ঘরকুনো মশা'। এরা আপনার সোফার কুশনের নিচে, পর্দার ভাজে এমনকি বিভিন্ন আসবাবপত্রের খাঁজে কিংবা ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকতে পারে। লকডাউনে শিশুরা বাসায় থাকাতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এরা সাধারণত দিনের বেলা আক্রমণ বেশি করে। তাই খুব বেশি কষ্ট না হলে অন্তত সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ রাখা গেলে মশার আক্রমণ থেকে বেশ খানিকটা নিরাপদে থাকা যাবে। ঘুমানোর সময় মশারি টানানো এডিস মশাকে আপনার থেকে দূরে রাখবে। তাছাড়া ঘরের আসবাবপত্র প্রতিদিন ঝাট দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমে থাকার বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার হয়, যেটি ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা। এটি করতে না পারলে চিকিৎসা দিয়ে কুলানো সম্ভব হবে না বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ঢাকায় অনেকেই ছাদকৃষির সাথে জড়িত। তাছাড়া বহু মানুষ বারান্দায় গাছ লাগান।গাছের গোড়ায় পানি জমে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে। তাই প্রতিদিন গাছের গোড়ায় পানি জমেছে কি না তা লক্ষ্য রাখতে হবে। পানি জমে গেলে সাথে সাথে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

তাছাড়া প্লাস্টিকের বোতল বা অন্য কোনো জিনিস ব্যবহারেও সতর্ক থাকতে হবে। বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে এডিস মশা যেন জন্ম নিতে না পারে তারজন্য চারপাশ যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে।

এত সতর্কতা সত্ত্বেও যদি কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েই যায় তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডেঙ্গু জ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। রক্ত প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস পান করলে উপকার পাওয়া যাবে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও মিষ্টি কুমড়াতে আছে ভিটামিন ‘এ’ যা প্লাটিলেট তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে খাদ্য তালিকায় মিষ্টি কুমড়া রাখতে হবে। শিশু কিশোররা এ সবজিটি খুব একটা পছন্দ না করলেও তাদের খাদ্য তালিকায়ও এটি রাখতে হবে। প্রতিদিন লেবুর পানি বা শরবত খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ থাকে। ভিটামিন সি রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও ভিটামিন ‘সি’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা পায়।

ডালিম রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর আয়রন রয়েছে যা প্লাটিলেট বৃদ্ধি করে। ডালিম দুর্বলতা দূর করে কাজে শক্তি দেবে। শুধু তাই নয়, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতেও ডালিম অত্যন্ত উপকারী।

এগুলো ছাড়াও ডাবের পানি, স্যালাইন কিংবা যেকোনো ফলের রস, মোটকথা বেশি পরিমাণে তরল খাবার আপনাকে ডেঙ্গু জ্বর থেকে সুস্থতা লাভ করতে দারুণভাবে সহায়তা করবে।

আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুই মাসে সাধারণত ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। তাই অন্তত এ দুই মাস খুব সচেতনভাবে থাকতে হবে। মনে রাখবেন ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। আর ভাইরাসজনিত রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা ঔষধ নেই। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা সচেতনতাই পারে আপনাকে ভাইরাসজনিত রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন। বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখুন।

লেখক: শিক্ষক ও নাগরিক সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/১৮জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা