বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষে স্বপ্নের ২১

এক দুরন্ত স্বপ্নবাজের ঐশ্বরিক স্বপ্নপূরণের গল্প

প্রকাশ | ২৫ জুলাই ২০২১, ১৭:২৮ | আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২১, ১৮:১৩

সঞ্জয় রায়

আবহমান কাল ধরে গঙ্গা-পদ্মার বঙ্গীয় অববাহিকা সমৃদ্ধ হয়ে এসেছে এক অনন্য লোকজ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর ভিত্তি করে। বাংলার শ্যামল প্রকৃতি, উর্বর মৃত্তিকা, বাণিজ্যিক প্রসারতা ইত্যাদি সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে বিশ্বের কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ছিল আমাদের এই রত্নপ্রসবা বাংলার মাটি। সংস্কৃতি ও প্রকৃতির এমন অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্যতায় এতটা নিপুণভাবে দৃশ্যমান হয়নি কখনো। এমনকি, একবিংশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক উন্নয়নের এমন স্বর্ণযুগে এসেও আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিই অন্যান্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে এখনো শ্রেষ্ঠতম অলংকার হয়েই সগৌরবে বিরাজমান।

বিশ্বের কাছে আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি ও প্রাচুর্যই সর্বসেরা হিসেবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের পটভূমিতে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে প্রবল সাংস্কৃতিক প্রভাব। ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি, যার আর কোনো উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের অবদান অসামান্য। বাংলার প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই লোকজ সংস্কৃতি যুক্ত হয়ে আছে। বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পালাগান, কীর্তন ইত্যাদি বহুবিচিত্র সংগীত শুধু বাংলার সংস্কৃতিকেই সমৃদ্ধ করেনি, বাংলার মার্গীয় সাধনতত্ত্বকেও নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রচ্ছন্ন বিরোধীরা সক্রিয় ছিল। অপসংস্কৃতির সেই পৃষ্ঠপোষকরা সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং আরও অনান্য প্রেক্ষাপট থেকে বহুবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক আভিজাত্যকে ধ্বংস করে নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য লেগে আছে । উল্ল্যেখযোগ্যভাবে মূলত বিগত কয়েক দশক থেকে তাদের এই প্রচেষ্টা বারবার প্রত্যক্ষভাবে চোখে পড়েছে। এমনকি, করোনাকালীন সময়ের বিবেচনায় স্বল্প পরিসরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ যখন উন্মুখ হয়ে ছিল, তখন বাংলার মাটিতে বাংলার স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভূলুণ্ঠিত করতে দেখেছি মহা বিস্ময় নিয়ে! এই পতন বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আঘাত, বাংলার গর্বের কৃষ্টি, শিল্প, মূল্যবোধ, চেতনার ওপর হামলা।

এই অপশক্তিটি প্রথম থেকেই জাতীয় সংগীত অবমাননার মতো একটি রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে এসেছে স্পর্ধার সঙ্গে। বাংলা নববর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে তারা বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে, বন্ধ করেছে সিনেমা হল, বারবার রক্তাক্ত করেছে সাংস্কৃতিক পরিবারের মানুষগুলোকে। যে সংস্কৃতি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বাংলার সব মানুষকে মানসিকভাবে এক করে রেখেছে, বাংলার চেতনার উদ্দীপনা হিসেবে জাগ্রত হয়ে আছে, ঠিক সেখানে আঘাত করে জাতীয়তাবাদের মূল স্তম্ভটিকে ভেঙে দিতে পারলেই যেন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়।

এমন একটি পরিস্থিতিতে সংগীতকে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা বর্তমান সরকারের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পুনরুদ্ধার নিয়ে বহুবিধ লেখালেখি চলছে। যদিও প্রগতিশীলরা বিভিন্ন কারণে সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালিত করতে পারেননি, তবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বারবার বিভিন্ন মহলের বুদ্ধিজীবীরা কলম চালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন বিগত দশক জুড়ে। একই সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে আয়োজিত টক-শোতেও বহুবার এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কারণ, তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন- একমাত্র ক্ষমতাসীন স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলটিই বাংলার সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করার মানসিকতা পোষণ করে। অন্য কোনো শক্তি এর অভ্যন্তরীণ গুরুত্ব অনুধাবন করে উত্তরণের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে না। তাই তারা বারবার এই বিশেষ ক্ষেত্রটির তৃণমূল পর্যায়ে সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় আনার লক্ষ্যে নিরলসভাবে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে গেছেন। সেই প্রচেষ্টা আজ সাফল্যের মুখ দেখেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।

এবারের বইমেলায় প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষে স্বপ্নের ২১ ' শীর্ষক একটি বিশেষ প্রবন্ধসংকলন পাঠ করার সুযোগ পেয়ে বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা, প্রকাশ ও যুক্তিবোধ সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণা লাভ করি। লেখক এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম বইটিতে বহু প্রসঙ্গে বারবার বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রটিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শুধু সরকারপ্রধান নয়, সর্বস্তরের জনসাধারণকে সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দায়িত্বপালনের কথা বলেছেন। সংগ্রহে রাখার মতো এই গ্রন্থে গ্রামভিত্তিক শিল্পকলা, পুলিশ সপ্তাহ দিবস প্রস্তাব, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহাবিশ্বে রবীন্দ্রনাথ, সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রস্তাব, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রস্তাব, সংগীত ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাবদর্শন বিশ্লেষণ, এমনকি ২০২১-৪০ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রূপরেখা কী হতে পারে ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর গবেষণালব্ধ ব্যাখ্যা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার যৌক্তিক প্রস্তাব ব্যক্ত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখকের নানা সময়ে প্রকাশিত এসব প্রবন্ধের কিছু সংখ্যককে সংকলিত করে প্রকাশিত গ্রন্থটি বাংলার চলমান অপসংস্কৃতিবিরোধী আন্দোলনে অবশ্যই এক নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে।

ইতিমধ্যে সরকার চলতি বছরের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আয়োজন করতে চলেছে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের, যেখানে ঘোষিত হতে চলেছে 'বঙ্গবন্ধু শান্তি পুরস্কার '। আলোচিত গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধটির বিষয় হলো 'বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার' প্রস্তাব, যা বইমেলার কথা মাথায় রেখে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল। অবশ্য, তার আগেই এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ কয়েকটি পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। এ যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে দেশের সব সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রতিভূ হয়ে লেখকের নিজেরই স্বপ্নপূরণের এক অনন্য গল্প।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দুরন্ত স্বপ্নবাজ এই লেখক একই সঙ্গে একজন গীতিকার, সুরকার, কবি এবং সংগীতশিল্পী। ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে সময়োপযোগী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গান পরিবেশন করে বিচারের পক্ষে দেশ-বিদেশের জনমত সম্পৃক্তকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

'গ্রাম্য ' শব্দটির প্রচলিত অর্থে 'অশালীন ' কথাটি ব্যবহার করায় তিনি বাংলা একাডেমির কাছে অর্থটির যৌক্তিকতা বিচারের প্রবল দাবি জানিয়েছেন তার নিজের লেখায়। মুজিব জন্মশতবর্ষে তার দুটি মৌলিক গান 'এক উত্থিত তর্জনী ' ও 'বাইগার থেকে বঙ্গবন্ধু’ বহুল সমাদৃত হয়েছে দর্শক-শ্রোতার কাছে। শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে সরকারের গৃহীত বঙ্গবন্ধু শান্তি পুরস্কার ও সংগীতকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার দুটি সিদ্ধান্ত যেন তার নিজেরই আদর্শের জয়, বহুদিনের লালিত স্বপ্নপূরণের গল্প, বঙ্গীয় সংস্কৃতির জয়।

অপশক্তির কটাক্ষ উপেক্ষা করে জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্তের মাঝে এই দুটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত তাকে বিশ্ব ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠ করবে তাতে কোনো দ্বিধার অবকাশ নেই। বাংলার সেই ঐতিহ্য, সেই গৌরব ফিরে আসুক আবার। শিল্প-সংস্কৃতির অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত হোক বাংলার মাটিতে। এভাবেই স্বপ্নবাজদের স্বপ্ন পূরণ হোক বারবার। প্রগতির জয় হোক। জয় বাংলা।

লেখক: কবি, গীতিকার।