সম্মান তো ভাই টাকায় কেনা সম্ভব নয়!

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০২১, ১৬:৩৯

জিনাত হাকিম

আলোচনা চলছে একটি নাটক নিয়ে যেখানে সন্তানের অটিজম ও জেনেটিক কন্ডিশনকে মা-বাবার পাপের শাস্তি হিসেবে ইঙ্গিত করে দেখানো হয়েছে। কতটা অমানবিক!

যিনি বা যারা কাজটাতে জড়িত তাদের বোধেই আসেনি বিষয়টা! বোধের গভীরতা নেই বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সাংস্কৃতিক  অঙ্গনে যে কেউ বিচরণ করতে চাইতেই পারে, তবে তাতে সংস্কৃতির ভাবমূর্তি নষ্ট করার দায়ভারও  কিন্তু তাকেই নিতে হবে।

স্বাধীন দেশে যা ইচ্ছে করার নাম ‘স্বাধীনতা’ নয়। যে যেই কাজের জন্য যোগ্য,  কাজটা তারই করা উচিত। ধরে নিলাম, আমার টাকা আর রুপ আছে। এখন যদি মনে হয় সুযোগ করে এই ‍ফ্যাসফেসে কণ্ঠে গায়িকা হব, নায়িকা হব। মোটা অঙ্কের টাকার  বিনিময়ে  নামকরা জনপ্রিয়  শিল্পীকে আমার বিপরীতে কাস্ট করে অভিনয়ে নেমে নিজের  একটা ‘তকমা’ জুড়ে নিলাম। তাতে কি পরিমাণ ক্ষতি আমি প্রফেশনালদের করলাম, শিল্পের ক্ষতি করলাম অনুভব করতে পারলাম  কি!

অনেকে অবশ্য বুঝেও তোয়াক্কা করছেন না। এর পেছনের কারণ তো স্পষ্ট। ঐ ধরনের ‘তকমা’ যুক্তরা আসলে মিডিয়ায় নিজের পকেটের টাকা বিনিয়োগ করে নিজস্ব মূল পেশার ও কর্মক্ষেত্রে (পেশাদার শিল্পী এরা নয়) একটা সুবিধা নিতে ব্যস্ত। নায়ক, নায়িকা, গায়ক বা স্বঘোষিত তারকা! ইত্যাদি যেকোনো পরিচিতি গড়ে তুললে সভ্য সমাজে জাতে উঠতে পারে বলে  মনে করে এরা। বাস্তবতা হলো , আপনি  নিজের টাকা মিডিয়ায় ঢেলে নিজেকে অর্বাচিনদের কাছে  এই লেবাসযুক্ত পরিচয় শো করে বাড়তি টাকা ‘কামাই’ করছেন। ভাবছেন সম্মানও কিনছেন। কারণ যত্রতত্র ইন্টারভিউ টক শোতে কথা বলছেন। হোক তা নিজের বা অখ্যাত চ্যানেলে।

কিন্তু  সম্মান? সম্মান তো ভাই টাকায় কেনা সম্ভব নয়! আসলে ‍প্রত্যেক মানুষের সম্মানের জায়গা তার যোগ্যতা অনুযায়ী স্ব-স্ব ক্ষেত্র। শুধু শুধু  গালি খেয়ে,  হাসির পাত্র হয়ে নিজেকে অপমানিত করে এরা।  তাতে করে দেশের শিল্প আর সংস্কৃতিরও যে ক্ষতি হচ্ছে তার খেসারত  তাকে দিতে হবে এমন আইন করা উচিত। তার  হয়তো শখ পূরণ হলো, কিন্তু সারা বিশ্বে আমার দেশ ও সংস্কৃতিকর্মীদের সম্পর্কে কি ধারণা তৈরি হচ্ছে, সেটার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই  সরকারকে করতে হবে। এখন সেই সময় এসেছে।

সাহিত্যচর্চা ছাড়া আপনি একটা-দুইটা বই ছাপাতে পারবেন। শখে গান, নাচ, অভিনয় সব করে পরিচিত মহলে আপনার শখের কীর্তিটি দেখাতে পারবেন, কিন্তু  লেখক-সাহিত্যিক, কবি, নায়ক, গায়ক বা ‘তারকা’  হয়ে উঠতে পারবেন না। এটাই সত্য।

আলহামদুলিল্লাহ্। আমাদের  এই প্রজন্মে অনেক অনেক মেধাবী যোগ্য  শিল্পী /তারকা আছেন। আমার  ব্যক্তিগত অভিমতে যাদের অবশ্যই পূর্ববর্তী যোগ্য অগ্রজদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তাদের দরকার সঠিক অভিভাবক- Captain of the ship.

একজন পাঠক, শ্রোতা, বা দর্শক  শিল্পী/তারকা  হিসেবে  যোগ্য জনকেই   স্বীকৃতি দেন।  আর যোগ্যতার কারণেই সেই শিল্পী বা তারকার জ‍ন্য একজন পেশাদার প্রযোজক অথবা টিভি ‍চ্যানেল  অর্থ বিনিয়োগ করেন। দর্শক চাহিদার ভিত্তিতে শিল্পীকে কাস্ট করতে হয়। যাকে অগণিত দর্শক তার হৃদয়ে স্থান দিয়ে ভালোবেসে ‘তারকা’ খ্যাতিতে ভূষিত করেন। নিজের টাকা ইনভেস্টমেন্ট করে যিনি ‘শিল্পী’ পরিচয়ে পরিচিতি পেতে চান তার স্থিতিও ক্ষণকালের হয়ে থাকে। নিজ পেশা ঠিক রেখে রাজনীতি, মিডিয়াকে ব্যবহারের (অপব্যবহারের) ধান্ধা ও অসাধু উদ্দেশ্যে নিয়ে যারা আসে, তাদের থামাবার সময় এখন। পাশাপাশি না বুঝে নির্বোধেরা যারা ইমেজ তৈরি করতে গিয়ে গালি খাচ্ছে, দয়া করে পরিবারের সদস্য-বন্ধু-স্বজনেরা বাহবা বা উৎসাহ না দিয়ে এদের প্রতিহত করুন। কাউন্সেলিংয়ে পাঠান। ইউটিউব, ওটিটি বা টিভি ‍চ্যানেল যেখানেই হোক ভালো কিছুই আমরা গ্রহণ করি। যারা বিভিন্ন  সুন্দর  ও গঠনমূলক  কন্টেন্ট  তৈরি করে সুন্দর সমাজ গঠন ও  সামাজিক সচেতনতা তৈরি করছেন তাদের সাধুবাদ ও অভিবাদন।

আর যারা অযোগ্য, সমাজের জন্য ক্ষতিকারক ও অপ্রতিরোধ্য আমরা তাদের বর্জন করি। তাদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। একটা দেশের সংস্কৃতি সেই দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, সম্মান বয়ে আনে। আর আমাদের  সমৃদ্ধিশালী ঐতিহ্যকে  আমাদের  নির্লিপ্ততায় আমরা বলি দিয়ে দিচ্ছি!

তথ্য মন্ত্রণালয়ের বা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছে নিশ্চয়ই। একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার যেখানে সমাজ, দেশ ও সাধারণ  মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক  মূল্যবোধে আঘাত করে, দেশের সংস্কৃতির ভাবমূর্তি নষ্ট  করে (বিকৃত ও বিতর্কিত কনটেন্ট নির্মাতা ও  সংশ্লিষ্টদের) তাদের  বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ ও বিচার করা হবে। দেশে একটি সম্প্রচার পর্যবেক্ষণ কমিশন করা দরকার।

অভিনেতা অভিনেত্রী নয় শুধু, দায় আমাদের সকলের। যে দায় এড়াবার কোনোই পথ থাকবে না অচিরেই এমন আইন ও তার বাস্তবায়ন দরকার।

লেখক: নাট্যকার-নির্দেশক 

 

ঢাকাটাইমস/২৭জুলাই/এসকেএস