মগবাজার বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাসটি ফিরে পেতে হয়রান সোহাগী

ধ্বংসস্তূপের সামনে স্বামীর স্মৃতি হাতে আহাজারি

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০২১, ২০:০৯ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২১, ২০:১৮

আল-আমিন রাজু, ঢাকাটাইমস

রাজধানীর মগবাজার বিস্ফোরণের মিনিট কয়েক মিনিট আগে সোহাগী বেগম তার বাসচালক স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন। মাত্র দেড় মিনিট। এরপর বিকট বিস্ফোরণ। সেই খবরও কিছুক্ষণের মধ্যে জেনে যান। মন অস্থির বোধ করলেও স্বামীর কোনো অমঙ্গল হয়নি বলেই বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। ওই বিস্ফোরণ তার স্বামীকে কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কষ্টার্জিত টাকায় কেনা বাসটিও বিধ্বস্ত করে দেয়। ঋণে কেনা সেই পোড়া বাস ফিরে পেতে এখন হয়রান সোহাগী বেগম। 

মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারানো ১২ জনের একজন আজমেরী পরিবহনের বাসচালক আবুল কাশেম। বিস্ফোরণের সময়ে মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে ছিলেন বাস নিয়ে।

সিগন্যালে আটকে থাকার সময়ই স্ত্রীকে ফোন দেন আবুল কাশেম। দেড় মিনিটের মতো কথা বলার পর গাড়ি চলতে শুরু করলে তিনি ফোন কেটে দেন।  স্ত্রীর সঙ্গে কথা শেষ করে যেতে পারেননি। তাই স্বামীর স্মৃতির সন্ধানে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছিলেন সোহাগী বেগম। মৃত্যুর আগে তার স্বামী কারও কাছে কিছু বলে গেছেন কি না সেই আশায় অপেক্ষা মগবাজারের আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটির সামনে। অপলক দৃষ্টিতে দেখেন বাড়িটির ধ্বংসস্তূপ আর চোখ বেয়ে অঝরে ঝরছে পানি।

মগবাজারের আউটার সার্কুলার রোডের ‘রাখি নীড়’ নামের সেই ভবনের সামনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সোহাগী বেগমের। জানালেন ঘটনার দিনের কথা। মগবাজার ওয়্যারলেস সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শেষবার আবুল কাশেম স্ত্রী সোহাগীর সঙ্গে কথা বলেন। স্ত্রীকে জানান, তিনি মগবাজার ওয়্যারলেস গেটে আছেন। গাড়ি নিয়ে গাজিপুর যাচ্ছেন। এরই মধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করে। সে কথা জানিয়ে ফোন রেখে দেন কাশেম।

মাত্র দেড় মিনিট স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ফোন কেটে দেয়ার পরপরই ঘটে বিস্ফোরণের ঘটনা। আর এতে গুরুতর আহত হন আবুল কাশেম। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই মারা যান তিনি।

সোহাগী বলেন, ‘ফোন কেটে যাওয়ার পর আমি মোবাইল রেখে ঘরের কাজ করছিলাম। এই সময় টিভিতে দেখি মগবাজারে সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তখন আমি নিজেকে আশ্বস্ত করি, আমার স্বামী যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সেটায় গ্যাসের সিলিন্ডার নেই। তেলের গাড়ি এটি। এরপর আমি গোসলে যাই। গোসল শেষে আসার পরে এবার টিভিতে বলছে, মগবাজারের একটি ভবনে বিস্ফোরণ। এই সময় আমি আমার স্বামীর মোবাইল ফোনে অনেকবার কল দেই, কিন্তু তিনি ধরেন নাই।

‘আমি চিন্তা করেছি হয়তো গাড়ি চালাতে ব্যস্ত, পরে কল দিবে। কিন্তু সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনি বিস্ফোরণে বাসের চালক ও হেল্পার আহত হয়েছেন। এই খবর শোনার পরে আমি রাত ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে আসি। দেখি আমার স্বামীর নিথর দেহ পড়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়।’

স্বামী আবুল কাশেম যে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন, সেটি ছিল সোহাগীর কষ্টার্জিত টাকা ও ঋণে কেনা। সোহাগী বলেন, ‘গার্মেন্টসে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। পরে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে এক বছর আগে বাসটি কিনেছিলাম। এখনো ঋণের টাকা শোধ করতে পারিনি। আর সেই বাস চালাতে গিয়ে জীবন গেল তার।’

প্রিয় মানুষটির মৃত্যুস্থলে এসে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না সোহাগী বেগম। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছিল তার। এক হাতে স্বামীর স্মৃতি, আরেক হাতে নয় বছর বয়সী মেয়ে মিমকে নিয়ে এখন পুলিশ আর আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন সোহাগী। ঋণের টাকায় কেনা বাস চালাতে গিয়ে প্রিয় মানুষটি হারিয়েছেন। কিন্তু ঋণের বোঝা মাথা থেকে নামেনি।

দুর্ঘটনার পরে বাসটি নিয়ে গেছে পুলিশ। সোহাগী বেগম বাসটি ছাড়িয়ে নিয়ে মেরামত করে আবারও রাস্তায় নামাতে চান। সে জন্য প্রতিদিন গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে তাকে। করোনার মধ্যেও প্রায় প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে কয়েকবার গাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু আজ তারা জানিয়েছে, আদালতের জিম্মায় আছে গাড়ি। আদালতের নির্দেশনা ছাড়া এই গাড়ি নেয়া যাবে না।

চোখের পানি মুছতে মুছতে সোহাগী বলেন, ‘আমার পাশে কেউ নেই। আমার একটা ভাই নেই। নিজেকেই সব করতে হচ্ছে। ছোট মেয়েকে নিয়ে এক মাস ধরে ঢাকা আসছি। একমাত্র আয়ের  মানুষটি এভাবে চলে গেল, বাসটি আটকে আছে পুলিশের জিম্মায়। কী করব বুঝতে পারছি না। অনেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও কেউ আর যোগাযোগ করেনি। লাশ নেয়ার সময় ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম প্রশাসন থেকে।’

নিহত আবুল কাশেমের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম ‍ উপজেলায় উনকোট এলাকায়। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন কাশেম।

গত ২৭ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ১০ জনই সড়কে চলাচলরত পথচারী ও যানবাহন চালক। বাকি দুজন হলেন ভবনের কেয়ারটেকার আবুল রশিদ ও বেঙ্গলমিটের কর্মী মো. ইমরান। এ ঘটনায় ৩৯ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ঢামেক হাসপাতালে ৩২ জনকে এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ডিএমপি রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

(ঢাকাটাইমস/২৭জুলাই/মোআ)