হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন পরিকল্পনা

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০৯:৫৪

সারা বিশ্বে মানব অস্তিত্ব আজ সংকটে। সংক্রমক রোগ তথা কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের সরকার ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করছে। যখন কোভিড ভ্যাকসিনের আবিষ্কার হয়নি তখন লকডাউন, মাস্ক, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা/প্রভৃতি কৌশল অবলম্বন করে আমরা কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছি। সংক্রমক রোগ তথা কোভিড নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনকে একটি সফল কৌশল হিসেবে দেখা হয়ে থাকে বিধায়, ফিজি সরকার কোভিড ভ্যাকসিনের বেলায় ঘোষণা করেছে যে যদি কোনো ব্যক্তি ভ্যাকসিন না নেয়, তবে তাদেরকে কাজে নেয়া হবে না। অস্ট্রেলিয়ার প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে এরকম একটি বিধিনিষেধ আছে। ভ্যাকসিন নেয়ার বিপক্ষে বিভিন্ন নৈতিক যুক্তি দেয়া হয়ে থাকে। সেই সব যুক্তি অসার প্রমাণে গবেষকরা উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন ইউরোপ হাম (measles) রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা বলা হয়েছে। তেমনি অস্ট্রেলিয়া ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল। বিভিন্ন ভ্যাকসিনের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলা হয়েছিল। পরিণামে ভ্যাকসিন থাকার পরেও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ১ কোটি বিশ লক্ষ মানুষ কঠোর লকডাউনের শিকার। আমরা জানি বাংলাদেশের মতো মধ্যআয়ের দেশগুলোর ভ্যাকসিন আবিষ্কার, ক্রয়, কাঁচামাল উৎপাদন, পর্যাপ্ত অর্থ সক্ষমতা নেই। প্রধানতঃ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শঙ্কা থেকে আমরা ভ্যাকসিন নেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি বা থাকি। দ্বিতীয়তঃ আমরা ভ্যাকসিন নেয়া থেকে বিরত থাকি নিজের প্রতি অতি আস্থা থেকে।

ভ্যাকসিনের প্রতি অনাগ্রহ ধনী কিংবা গরিব হওয়ার উপর নির্ভর করে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন যারা তারা মনে করে ভ্যাকসিন পুঁজিবাদের আগ্রাসন। আর কিছু বুদ্ধিষ্ট মনে করেন জীব হত্যা মহাপাপ। ভ্যাকসিন ভাইরাস হত্যা করে। সুতরাং, ভ্যাকসিন বর্জন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিক। অনেকেই ভ্যাকসিন দেয়া থেকে বিরত থাকে নানান বিষয় বিবেচনা করে। কেউ মনে করে সময়টি উপযুক্ত নয়, কেউ মনে করে ভ্যাকসিন কোয়ালিটি উপযুক্ত নয়, কেউ মনে করে যিনি ভ্যাকসিন দিচ্ছেন তিনি উপযুক্ত নন। অর্থাৎ কেউ ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধান্বিত উপযুক্ত কারণে আবার কেউ মনের ইচ্ছার উপরে ছেড়ে দেন। ধর্মীয় কারণেও অনেকে ভ্যাকসিন নিতে চায় না। এমনকি যারা বয়স্কদের সেবা দিচ্ছে তারও ভ্যাকসিন নিচ্ছে না। আর প্রকৃতিবাদীরা প্রকৃতির নিয়মে চলতে ভালোবাসেন।

বয়স্ক বা শিশুদের জন্য ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যতামূলক করবার অন্যতম কারণ হলো জনকল্যাণ (public good) নিশ্চিত করা। কিন্তু শিশুদের জন্য ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করলে অভিভাবকের উপর বল প্রয়োগ করা হয় এবং অভিভাবকের অধিকারসমূহ ক্ষুণ্ন হয়। আর বড়দের জন্য ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করা হলে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এভাবে স্বাধীনতা হরণ ও বলপ্রয়োগ যুক্তিযুক্ত প্রমাণ বেশ কঠিন। প্রথমতঃ আমরা জানি ভ্যাকসিন শতভাগ কার্যকরী নয়। দ্বিতীয়তঃ ভ্যাকসিন নিলেও একজন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

ভ্যাকসিন নেয়াকে আমরা বিভিন্নভাবে বাধ্যতামূলক করতে পারি। এই প্রক্রিয়ায় একটি পরোক্ষ পদ্ধতি হলো নুড্জিং (nudging)। আরেকটি পদ্ধতি হতে পারে ভ্যাকসিন না নিলে জরিমানা করা বা অতিরিক্ত কিছু আদায় করা। তবে এই পরোক্ষ পদ্ধতিও কারো কাছে জোর করা মনে হতে পারে এবং এটি বলপ্রয়োগ ও স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে সরকারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতে হলে কিছু ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যতামূলক। এখানে নীতিটা হলো no jab no pay. যুক্তরাষ্টের কোনো কোনো প্রদেশে (state) ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কারণে ভ্যাকসিন নেয়া থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেলেও অধিকাংশ প্রদেশে immunization বাধ্যতামূলক।

ভ্যাকসিন না নেয়াকে অপরাধ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এবং সেজন্য জরিমানা বা জেল দেয়া যেতে পারে। এভাবে কঠোর আইন করা হলে ভ্যাকসিন নেয়াটা বাধ্যতামূলক (compulsory)। ভ্যাকসিন নেয়া সকলের জন্য বাধ্যতামূলক বা ভ্যাকসিন না নেয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা বঞ্চিত না করে কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেয়ার পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন ভ্যাকসিন নেয়া থাকলে চলাচলের স্বাধীনতাকে বৃদ্ধি করতে পারি অথবা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে বাড়াতে পারি। এভাবে যদি আমরা অগ্রসর হই তবে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি গ্রহণযোগ্য বা যুক্তিযুক্ত নাও হতে পারে। এটাকে এক্সপ্লয়টেশন হিসেবে দেখা যেতে পারে। এখানে ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে আমরা প্রভাবিত করছি বিধায় সিদ্ধান্তগুলো স্বাধীন ও যৌক্তিক হচ্ছে না বলে অভিযোগ করা যেতে পারে। তবে প্রণোদনা যদি বেশি হয় তবে সেটা অনৈতিক হয় বলে অনেকে মনে করে।

করোনাভাইরাস সারা বিশ্ব ছড়িয়ে যাওয়ার পর আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। সেসব পদক্ষেপ ছিল ভাইরাস থেকে মানুষকে নিরাপদে রাখা। যে ভাইরাসে আক্রান্ত তাকে isolation এ রেখেছি, কোয়ারেন্টাইন সিস্টেম প্রবর্তন করেছি, সার্ভিলেন্সের অংশ হিসেবে কন্টাক্ট ট্রেসিং এর ব্যবস্থা করেছি। আমরা লকডাউন দিয়েছি, যাতে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি তাদেরকে রক্ষা করবার অভিপ্রায়ে। এখানে যে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখেছি তা হলো অন্যের ক্ষতি না করা সরকার ও নাগরিকের দায়িত্ব। আমরা একইভাবে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন দেয়াকে প্রবর্তন করতে যুক্তি দিয়েছি যে নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন ভুক্তভোগী বা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এখানে ক্ষতি কেবল আর্থিক নয় জীবননাশের মতো ক্ষতি হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে জানিয়েছেন। এবং বাস্তবিকই আমরা করোনাভাইরাসের ক্ষতির পরিমাণ ও মাত্রা দেখতে পাচ্ছি।

আমরা সকলেই নীতিদর্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের সঙ্গে একমত যে প্রত্যেক নাগরিক তার স্বাধীনতাকে ভোগ করবে অন্যের কোনো ক্ষতি না করে। সরকার যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয় তবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে সকলকে বিপদে ফেলবে। সুতরাং কোনো একটি ব্যবস্থা নেয়া একান্ত জরুরি। সরকার ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক ছাড়া আর কি করতে পারে? শিশুদের নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা আমার জানি। তাদেরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা বা তাদের কল্যাণ নিচ্চিত করা আমাদের বা সরকারের দায়িত্ব। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ নিজের ক্ষতি জেনে শুনে করতে পারে। কিন্তু শিশুরা সেরকম সক্ষমতা রাখে না। সুতরাং, শিশুদের কল্যাণ এবং তাদের জীবন রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করা হবে কি না? ভ্যাকসিন না নিলে জনস্বাস্থ্যে কি খুবই প্রভাব পড়বে?

সম্প্রতিকালের এক বিখ্যাত অক্সফোর্ড নীতিদর্শনিক জুলিয়ান স্যাভেলেস্কু (Julian Savulescu)মনে করেন, কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধের জন্য বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়া নৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে যদি আমরা মনে করি জনস্বাস্থ্যের জন্য এই ভ্যাকসিন না নেয়াটা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ, সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা আস্থা উচ্চ, বিকল্পগুলির তুলনায় বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়ার প্রত্যাশিত উপযোগিতা বেশি, এবং অনুপযোগের জন্য জরিমানা বা ব্যয় আনুপাতিক। জরিমানা দেয়া বা খরচসমূহ বহনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কিছু সুবিধা প্রদান স্থগিত রাখতে পারে, আর্থিক জরিমানা করতে পারে, জনসেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা বা স্বাধীনতা সীমিত করা যেতে পারে। এবং জরিমানা আদায় আর্থিক বা বস্তু হতে পারে।

বিভিন্ন কারণে আমরা ভ্যাকসিন নিতে বা শিশুকে ভ্যাকসিন দিতে সংশয় করতে পারি। যেমন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা, শিশুদের বেলায় ভ্যাকসিন গ্রহণের উপযুক্ততা, রোগের প্রাদুর্ভাব না থাকা, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির উদ্দেশ্যে, পাবলিক হেলথ সিস্টেমের প্রতি আস্থার ক্রমনিম্নগামী, ভুল তথ্য, শক্তি প্রয়োগের ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রভৃতি বিষয়গুলো আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। আমার আমাদের এই বিবেচ্য বিষয়গুলোকে উপরোক্ত বিভিন্ন নৈতিক মানদণ্ডের আলোকে পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। এবং আমরা সেই পর্যালোচনা থেকে যেন আমাদের সিদ্ধান্ত নিঃসৃত হয়। আমাদেরকে নিজের ও অন্যের ক্ষতির বিষয়ে ভাবতে বলা হয়। আমি ভ্যাকসিন নিলে আমার কি ক্ষতি এবং আমি অন্যের ক্ষতি করতে পারি কিনা বিবেচনা করতে পরামর্শ দেয়া হয়। আমরা সেসব অনুসন্ধান থেকে জানতে পারি গভীর ও সূক্ষ নৈতিক বিষয়গুলোকে।

হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করবার দাবি বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এসেছে। হার্ড ইমিউনিটি আমরা অর্জনে সুইডেনকে লকডাউন বা ব্যাপক ভ্যাকসিনের পথে যেতে দেখছিনা। এমন একটি পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিক পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমার এ প্রবন্ধ সেরকম একটি বিবেচনা থেকে উপস্থাপিত।

ভ্যাকসিন নেয়া আমাদের আচরণের একটি দিক। যদি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে আমরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ভ্যাকসিন নেবো। কিন্তু আমরা যদি সেরকম আচরণ না করি এবং এতে করে সামগ্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তবে সরকার ভ্যাকসিন নেয়াকে বাধ্যতামূলক করবে। এভাবে সরকার দায়মুক্ত হতে পারে কিনা এবং আমরা নাগরিকরা আমাদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজের মানুষের প্রতি যে দায় আছে সেটাকে পালন করতে পারি কিনা? নৈতিক এসব প্রশ্নর উত্তর আমাদের অনুসন্ধান খুবই জরুরি।

আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে কোভিড ভ্যাকসিন দিতে দেখছি। সেখানে বিষয়টি এখনো বাধ্যতামূলক নয়। কিছু কিছু প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা তৃতীয় পক্ষ থেকে দেয় হবে বলে জানানো হয়েছে। সেগুলো নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য কিনা সে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। ধরা যাক, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ভ্যাকসিন নেবো না। এবং আমি ভ্যাকসিন না নিয়ে ক্লাস ও অফিস করা শুরু করলাম। অপরদিকে আমার সহকর্মীরা ভ্যাকসিন নিয়েছেন। আমার ভ্যাকসিন না নেয়ার কারণে আমার ক্ষতি হবে। আমি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হতে পারি। অপরদিকে আমার থেকে এই জীবাণু আমার সহকর্মীকে আক্রান্ত করতে পারে। এবং এটি বিস্তৃত হতে পারে। সরকার এই সংক্রমণ প্রতিরোধে কি ব্যবস্থা নেবে যা হবে নৈতিক? সরকার সকলকে ভ্যাকসিন নিতে উদীপ্ত করতে পারে বিভিন্নভাবে। সেটা কিভাবে নৈতিক হবে? সরকারের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া আছে। সরকার কি ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করবে না কি এটি নাগরিকের ইচ্ছার উপর রেখে দেবে?

আমরা দেখেছি অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন রোগের নিরাময়ে বিভিন্ন ঔষধ সেবন করে বা ইনজেকশন নিয়ে থাকে। এখানে রোগী মনে করে ওই ব্যবস্থাগুলো নিরাপদ, কার্যকরী এবং কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলো একেবারেই নতুন। খুব দ্রুততম সময়ে এই টিকাগুলো বাজারজাত করা হয়েছে। এবং একারণে, মানুষের মনে এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অজানা রয়ে গেছে।

এরকম পরিস্থিতিতে টিকা বাধ্যতামূলক করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে কি? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো- পারে না। কারণ, মানুষকে ভাবতে সময় দেয়া এবং তথ্য দেয়াকে অনিবার্য শর্ত বলে আমি মনে করছি। এরই মাঝে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার শর্ত হিসেবে টিকা নেয়া শর্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরকম শর্ত বলপ্রয়োগ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা পরিপন্থী। এবং এ কারণে সার্বজনীন নৈতিকতার আলোকে অনৈতিক বলে বিবেচিত।

টিকা বাধ্যতামূলক না করায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অধিক সংখ্যক মানুষ টিকা নেয়ার ফলে রাষ্ট্র যদি হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করে, তবে নাগরিক হিসেবে কি আমি জনকল্যাণের মতো বিষয়ে ন্যায় আচরণ করি? অর্থাৎ, বিনা অবদানে আমি একটি সুফল ভোগ করছি সেটা নৈতিক কি? ভাইরাস সংক্রমণ রোধে কিছু নাগরিক টিকা নিতে যদি দেরি করে এবং তাতে যদি যারা টিকা নিয়েছে তারও ক্ষতির সম্মুখীন হয় ভাইরাস সংক্রমণ অব্যাহত থাকার ফলে তবে কি আমাদের আচরণ নৈতিক বিবেচিত হতে পারে? এবং এরকম ক্ষেত্রে টিকা বাধ্যতামূলক না করবার জন্য সরকারকে দায়ী করা যায় কি? এক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে নাগরিক হিসেবে আমার একটি দায় আছে যা সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা (justice) বা ন্যায্যতার (fairness) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত- সেটি হলো অন্যের ক্ষতি না করা, কোনো অবদান রেখে নাগিরক সুবিধা নেয়া বা না নেয়া এবং নিজের নাগরিক দায়িত্ব পালন না করা। এরকম পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যারা আগেভাগে টিকা নিল তাকে পুরস্কৃত করার জন্য কোনো আর্থিক বা বস্তুগত উপহার দেয়া অন্যায় প্ররোচণা (unfair inducement) হিসেবে গণ্য করা হবে কি?

ভাইরাস মুক্ত নিরাপদ পরিবেশ একটি জন কল্যাণ ও বিষয় (Public good) সমাজের সকল নাগরিকের কাম্য। এবং এমন একটি সামাজিক লক্ষ্যে প্রতিটি নাগরিকের সংহতি প্রকাশ একান্ত কাম্য। সেই সামাজিক সংহতি প্রকাশ হতে পারে নিজের মূল্যবোধ, ধর্মীয় সংষ্কৃতি বিসর্জন, চাঁদা বা আর্থিক দণ্ড, ঝুঁকি নেয়া, প্রভৃতি উপায়ে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় বা মূল্যবোধ আছে যা আর্থিক আকারে রূপান্তর করা যায় না বলে আমরা জানি।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া ও অন্যদিকে ঝুঁকি নিয়ে আগেভাগে টিকা নেয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় ও প্রতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দায়িত্ব পালনে আমাদের অংশগ্রহণ ও সংহতি প্রকাশ কিভাবে হওয়া উচিত? আমাদের আগাম ঝুঁকি নেয়ার জন্য কোনো পুরস্কার থাকা এবং যারা টিকা নেবে না বা পরে নেবে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তাদের অবদান রাখবার বিধান থাকা প্রয়োজন আছে কি? যদি থাকে তবে সেটা কিভাবে হতে পারে?

আমাদের মনে রাখতে হবে গৃহীত পলিসি বা নীতি, আইন যেন ন্যূনতম বল প্রয়োগ করে বা আর্থিক বোঝা চাপায় বা খুবই সীমিত পরিমাণে স্বাধীনতা খর্ব করে এবং আমাদের দৈহিক পবিত্রতা/শুদ্ধতা নিশ্চিত করে। গবেষকের অনেকেই টিকা দেয়াকে বাধ্যতামূলক করবার পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা অনেকে বলবেন সকলেই ভাববে আমি টিকা না দিলেও চলবে কারণ অন্যরা দেবে। এভাবে দেখলে টিকা নেয়ার মানুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং এটি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করবে যে সমাজ থেকে কোভিড-১৯ নির্মূল অসম্ভব হয়ে যাবে। আমার জানি ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ আমার আরও জানি ‘বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়া তোলে সাগর অতল”। এভাবেই নীতি দার্শনিকরা The Duty to Easy Rescue এর কথা বলেছেন। নীতিদার্শনিকরা করেন, উপযোগিতাবাদ, কর্তব্যের জন্য কর্তব্য, ভার বহনের বেলায় ন্যায্যতা নীতি, প্রভৃতি বিষয়গুলো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নৈতিক আদর্শ হলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করে আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখতে পারি।

আমরা রোগীদের সেবাদানকারী সংস্থার সকলকে টিকা নেয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছি। এখানে আমরা রোগীর ক্ষতি না করা, আস্থা অর্জন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মহান সেবা প্রতিপালনের শপথকে সিদ্ধান্তগ্রহণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছি। এভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ নৈতিক কিনা বিতর্ক করা যেতে পারে। নীতিদার্শনিক স্যাভেলেস্কু মনে করেন, যদি আমরা মনে করি কোভিড-১৯ একটি মরণব্যাধি, যদি টিকা দেয়া সেই ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয়, এবং সেজন্য যদি বলপ্রয়োগ/পরিমিত বলপ্রয়োগ, সরকারি সুবিধা কর্তন, কোনো প্রকার প্রণোদনা দেয়া কার্যকরী ফল বয়ে আনে তবে টিকা দেয়া বাধ্যতামূলক করা যায়। আমরা বাংলাদেশের সমাজকে কোভিড-১৯ টিকা নেয়া বাধ্যতামূলক করে যে সুফল পাওয়া যাবে সেই সুফল থেকে সকলের জন্য প্রণোদনা দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এবং সেটা হতে পারে সরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবা সুলভ মূল্যে সরবরাহের একটি কার্ড।

লেখক: ন্যায় ও সুশাসন গবেষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :