শিশুর মতো লালন করেছেন বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন

আব্দুল্লাহ আল হাদী
| আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২১, ১৬:০৭ | প্রকাশিত : ০৮ আগস্ট ২০২১, ২১:১৩

শিশুর মতো লালন করেছেন বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন। জেলগেটে যখন বারবার দেখা করতে গেছেন কোনো ক্লান্তি অনুভব করেননি। শুধু ভাষা আন্দোলনের অনশনের সময় জেল থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ধরে একবার কেঁদে ফেলেছিলেন এই বলে যে 'তোমার যদি কিছু হয়ে যেত'।

বঙ্গবন্ধু মুজিব যখন বি, এ পরীক্ষার্থী কোলকাতায় পার্ক সার্কাসে ছোট বোনের বাসায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেখানে একজন পরীক্ষার্থীকে সাহায্য করার জন্য তখন তিনি সেখানে হাজির ছিলেন। প্রতি পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়েছেন তিনি জীবনের নিঃশ্বাস খুঁজে খুঁজে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং এরপর যখন ২১ দফার প্রশ্নে যুক্তফ্রন্ট আপস করায় আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার ব্যবস্থা নিল, তখন বদরুন্নেসা আহমেদ নামে চট্টগ্রাম থেকে একজন এম.এল.এ প্রায়ই এ সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে পত্র দিতেন তার মধ্যে ২৩.০২.১৯৫৫ তারিখের একটি পত্রে তিনি লিখছেন-

'মুজিব ভাই' -------

এরপর আওয়ামী লীগ নিয়ে বদরুন্নেসা আহমেদের অনেকগুলো পরামর্শ, ২১ দফা মানা না মানা নিয়ে নানা অভিযোগ অনুযোগ এবং এরপর একদম শেষ প্যারায় তিনি লিখছেন- ‘আপনার গৃহিনীকে আদাব জানবেন। তাঁর কাছ থেকে Training নেবেন কিভাবে স্থির হয়ে ভাবতে হয়। 'Demagogy' আর চলবে না। জুয়াল আপনাদের ঘাড়ে পড়েছে, সুতরাং মাটির দিকে নজর রেখে ভবিষ্যতের ফসলের উপর খেয়াল রেখে কাজ করতে হবে। আরজ গুজার, ইতি-বদরুন্নেসা আহমদ

এ ধরনের আরও কয়েকটি পত্র থেকে সহজেই অনুমান করা যায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী কিংবা পাবলিক ডিপেন্ডেন্সিটা প্রথম থেকেই ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে শনাক্ত করতে পেরেছিল। তিনি এই সমস্ত কাজ স্থির থেকে সম্পূর্ণ নিভৃতে করে যেতেন। এবং কীভাবে স্থির হয়ে ভাবতে হয় তার আরো কয়েকটা নজির বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ হয়ে ধরা দিয়েছে, যেমন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা না ৮ দফা এ বিতর্কে বঙ্গমাতা তার ধীর স্থির সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু মুজিব প্যারলে মুক্তি নেবেন কি নেবেন না, সে প্রশ্নেও বঙ্গমাতা তাঁর স্থির ভাবনা দিয়ে বাঙালিকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণে যাওয়ার আগে তিনি আগের মতোই বঙ্গবন্ধু মুজিবকে স্থির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গমাতাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল এবং তাঁকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তখনও তিনি স্থির থেকে সবকিছু প্রতিহত করেছেন তাঁর অবিচল প্রতিমূর্তি নিয়ে।

১৯৫৮-১৯৬২ এর সময়ে তিনি জেলখানায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য যেসকল আবেদনপত্র দিয়েছিলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত ১০.০৩.১৯৬২ সালের একটি আবেদনপত্রে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নামে ছাপানো প্যাডে 'শেখ মুজিবুর রহমান' এই নামের আগে শুধু 'বেগম' শব্দটি হাতে লেখা, এরকম প্যাডেই তিনি তখন আবেদনগুলো করেছিলেন।

সেসব আবেদন থেকে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু মুজিবের জন্য জেলখানায় গরমের সময় গরমের কাপড় পৌঁছে দেওয়া, শীতের সময় শীতের কাপড়, নির্দিষ্ট সময় পর পর জেলখানায় নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা, ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁদের বাবার সঙ্গে জেলগেটে দেখা করানো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য উকিলদের সাথে পরামর্শ করা। দুর্যোগে, দুর্ভোগে ঈদ কিংবা উৎসবে তিনি পাশে থেকেছেন নিবিড় নিষ্ঠা নিয়ে।

পাশাপাশি জেলের বাইরে নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখা, তাদের পরিবারের অবস্থার খোঁজ-খবর নেওয়া, জেল থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশনা সব জায়গায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি নানা কাজ প্রতিমুহূর্তে পালন করে গেছেন তিনি অথচ কেউ কোনদিন জানতে পারেনি এই মহীয়সী মানুষটির নাম। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ শেষে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নির্দিষ্টভাবে প্রভাবিত করে গেছেন এবং তাদের পুনর্বাসন করেছেন।

বঙ্গমাতা খুবই শিক্ষানুরাগী ছিলেন তা বোঝা যায় তিনি এতো ঝঞ্ঝার মধ্যেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। এমনকি তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিবকেও জেলখানায় বইয়ের পাশাপাশি রুলটানা খাতা সরবরাহ করতেন। বর্তমান সময়ে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু মুজিবের ডায়েরি 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' 'কারাগারের রোজনামচা' 'আমার দেখা নয়াচীন' তাঁরই চেষ্টার অসামান্য অবদান।

বঙ্গবন্ধু মুজিবের সাথে একাত্মা হয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মুক্তির স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন বাংলার দুঃখী মেহনতি সংগ্রামী মানুষের মুক্তির সহযাত্রী হয়ে। এবং তাঁর এই সহযাত্রা তিনি প্রমাণ করেছেন শেষ পর্যন্ত তাঁর সাদামাঠা এক সহমরণের মধ্য দিয়ে।

এই মহীয়সী স্মৃতির প্রতি আমাদের জীবন জীবনের শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র-[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol 1-7.] গ্রাফিক নোবেল মুজিব, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ - শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ছবি - ফটো আর্কাইভ- মুজিব হান্ড্রেড ইয়ার্স, বিবিধ।

লেখক: কবি ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :