খাদ্যে ভেজাল মেশানো বাংলাদেশের এক ভয়াবহ সমস্যা

রবিউন নাহার তমা
 | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০২১, ২০:০৮

সন্ধ্যার পর রাশেদের খুব অস্থির লাগা শুরু করল। মাথা ঝিমঝিম অনুভুতি। শ্বাস আটকে আসতে লাগতে লাগল। ঘাড়ে হালকা ব্যাথা।মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করায় সেও বলল তার বুক জ্বলে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে ভাবতে ভাবতে রাশেদের মনে পড়ল যে বাজার থেকে কিনে আনা বাঙ্গি আর তরমুজ কিনে আনার পর তাড়াহুড়ায় ভিজিয়ে রাখা হয়নি। বিকেলে নাশতার আগে শুধু ধুয়ে কাটা হয়েছে। তারমানে ফরমালিন এফেক্ট।ফুড পয়জনিং...!

খাদ্যে ভেজাল মেশানো বাংলাদেশের এক ভয়াবহ সমস্যা। সময়ের সাথে সাথে এর মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে মানুষ যখন অর্গানিক আর ভেজালবিহীন খাবারের দিকে ঝুঁকছে সেখানে আমাদের দেশে চলছে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর তুমুল প্রতিযোগিতা। সাধারণ মানুষ আর কতৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিনব কায়দায় খাবারে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন,কীটনাশক, আর্সেনিক, কার্বাইডসহ অসংখ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ।পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের শিল্পখাতে ৪০-৪৫ টন ফরমালিন প্রয়োজন ছিল।কিন্তু আমদানি করা হয় ২০৫ টন।

অতিরিক্ত আমদানিকৃত এই ফরমালিন তাহলে কোথায় গেল? সোজা কথায় বললে এর পুরোটাই খাদ্যের সাথে গিয়েছে দেশবাসীর পাকস্থলীতে। অন্যদিকে ডয়েচে ভেলির ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে, দুই লক্ষ মানুষ কিডনীর রোগে এবং তিন লক্ষের মত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে।

তবে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশু ও গর্ভবতী মায়ের।বাজারে পাওয়া শিশু খাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগই ভেজাল।দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যায় তার ১০ শতাংশের কারণ ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য।কাপড়ে ব্যবহৃত রঙ,কৃত্রিম ফ্লেভার,ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরণের জুস ও জেলিসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য। আর এসব পন্যের প্রধান ভোক্তা হচ্ছে শিশুরা।এজন্যই বাংলাদেশের দেড় থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।

এখানেই শেষ নয়। ফার্মের মুরগির খাবারে মেশানো হয় আর্সেনিক। মাছের খাবারে মেশানো হয় মুরগির বিষ্ঠা ও আবর্জনা। দেশের ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের একটি প্রিয় খাবার হলো শুঁটকি। অথচ এই শুঁটকিতে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক। কীটনাশক একবার শরীরে প্রবেশ করলে তা আর বের হতে চায় না। জীবনভর ক্ষতি করে যায়। কীটনাশকের কারণে শরীরের অস্থিমজ্জা,যা থেকে লোহিত রক্ত কনিকা সৃষ্টি হয় তা কার্যকারিতা হারাতে পারে।

দেশে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো খাবারে কীটনাশকের উপস্থিতি। এছাড়া গর্ভবতী নারী কীটনাশকযুক্ত খাবার খেলে শারীরিক ও মানসিক বিকারগ্রস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। কীটনাশক শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী। শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে মৌসুমি ফলের জুড়ি নেই। অথচ সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয় ফল পাঁকাতেই। আম,তরমুজ,বাঙ্গি,লিচু এসব ফল বাজার থেকে কিনবেন অথচ তাতে রাসায়নিক পদার্থ থাকবে না ভাবাই দায়!চাষিদের থেকে পাওয়া তথ্য বলে বাগানভেদে শুধুমাত্র লিচুতেই ২৩ রকমের রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়।

গ্রামাঞ্চলে তরতাজা খাদ্যশস্য মিললেও শহরের বাজারগুলো ভেজালে সয়লাব। এখানে ভেজাল ছাড়া খাবার পাওয়া রীতিমত সোনার খনি পাওয়া। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ২০১৮ সালে সারাদেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) মোট ৫৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে। ভেজালের পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এরমধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ। এভাবে চলতে থাকলে রোগাক্রান্ত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।যার মাশুল হয়তো নিশ্চিহ্ন হওয়ার মধ্য দিয়েই দিতে হতে পারে।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল,ওষুধ মেশালে, ভেজাল খাদ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে কিংবা বিক্রি করার জন্য প্রদর্শন করলে অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। তবে এ আইনের আওতায় আজ পর্যন্ত কারো শাস্তির নজির পাওয়া যায়নি। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯,নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩,ফরমালিান নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫,দন্ডবিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ আছে।এসব আইনের আওতায়ই মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়।

বিভিন্ন আইন থাকায় দেখা যায় একই অপরাধে শাস্তির মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়।শাস্তির মাত্রা নির্ভর করে কোন আইনে মামলা হয় তার ওপর।নিরাপদ খাদ্য কতৃপক্ষ বলছে যথাযথ শাস্তির বিধানে আইনগুলোর সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে ২০১৮ সাল থেকে ২রা ফেব্রুয়ারিকে 'নিরাপদ খাদ্য দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এছাড়াও ২০১০ সালে গঠন করা হয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে এসব দিবস কিংবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। বিশেষ সময়ে বা ইস্যুতে তাদের তৎপরতা দেখা যায়। যেমন-

রমজান মাসে ব্যাপকভাবে সারা দেশব্যাপী ভেজাল বিরোধী অভি্যান হয়। কারণ এসময় অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌড়াত্ম্য বাড়ে।

ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদে থাকতে হলে কিছু সাধারন পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমেই যেটা প্রয়োজনীয় তা হলো ভেজালমুক্ত খাবার চিনতে হবে। সতেজ খাবারের রঙ হবে উজ্জল এবং স্বাভাবিক। সেটা মাছ-মাংস,সবজি বা ফল যাই হোক না কেন। যেমন-কলা হবে চকচকে হলুদ রঙের। তাজা মাছের আইশ হবে উজ্জ্বল আর চোখ হবে পরিষ্কার। খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে এরকম সাধারণ তথ্যগুলো জানতে হবে।

অচিরেই লিটমাস ট্রিপের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। বুয়েটের একদল গবেষক এক ধরণের লিটমাস ট্রিপ আবিষ্কার করেছেন যেটির মাধ্যমে ক্রেতা নিজেই খাদ্যে ভেজাল আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে পারবেন। যে খাবারে ফরমালিনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারবেন। যে খাবারে লিটমাসের পরিমাণ যত বেশি থাকবে লিটমাস পেপারটি তত বেশি গাঢ় বেগুনি রঙ ধারণ করবে। দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'রেনাটা লিমিটেড' সাধারণ মানুষের হাতে এটি তুলে দেয়ার জন্য ইতোমধ্যেই এর উৎপাদন কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাজারজাত করণের জটিলতা কাটিয়ে এই লিটমাস ট্রিপ মানুষের হাতে তুলে দিতে হবে।

ছাদ কৃষিকে আরও বেশি উৎসাহিত করতে হবে। ঢাকা শহরে কিংবা অন্যান্য বড় বড় শহরে খালি পড়ে লক্ষ লক্ষ ছাদে সবজি বা ফলের বাগান করা হলে তা নিজেদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার কিছুটা হলেও মেটাতে পারে। এতে ভেজাল খাদ্য তুলনামুলক কম পাকস্থলীতে যাবে। তবে এডিস মশা যেন না হয় সে ব্যপারে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে।

শিশুদের ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। জাংকফুড যদি নিতান্তই দিতে হবে তবে তার মেয়াদ,উপাদান,কোন কোম্পানির তৈরি তা ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। নিজেদেরও কম খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

সর্বোপরি যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন তা হলো সম্মিলিত পদক্ষেপ। আইন প্রয়োগ করে কিংবা সচেতনতা দিয়ে রাস্তার ছোটখাটো ব্যবসায়ীকে হয়তো থামানো যাবে, কিন্তু যারা বড় ব্যবসায়ী কিংবা খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মূল হোতা তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। এজন্য শুধু সরকারকে দায়ী করে নয়,বরং জাতিগতভাবে একসঙ্গে প্রতিবাদের মিছিলে নামতে হবে। তা না হলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :