লোকসান সঞ্চিতি ঘাটতি ঋণ নিয়েও ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী

প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০২১, ১১:৫৪ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:০১

রহমান আজিজ, ঢাকাটাইমস

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের তিন বছরে নিট মুনাফা ৪৪ কোটি ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা। আর মাত্র দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসান ১০০ কোটি ৯৫ লাখ ২ হাজার টাকা। ১৬৪ কোটি ৬ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঞ্চিতি ঘাটতি ১১৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ৩২০ কোটি ৪৭ লাখ।

প্রতিষ্ঠানটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ফারইস্ট ফাইন্যান্সেরপরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবু ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আর্থিখ খাতের এ প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনও লভ্যাংশ দেয়নি শেয়ারহোল্ডারদের।

২০২০ সালে ডিসেম্বর প্রান্তিক এখন প্রকাশ ও বার্ষিক প্রতিবেদনও প্রকাশ কেরনি প্রতিষ্ঠানটি। তবু ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার দর গত তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১৯৭ শতাংশ। হু হু করে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে কারসাজিকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট্ররা।

প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আর্থিক খাতের ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে আড়াই শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ, ২০১৫ সালে ১০ ও ২০১৬ সালে ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। এরপর ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এমনকি ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের তিন মাসে (জুন-সেপ্টেম্বর) প্রান্তিকে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) .৫৯ টাকা। এবং এবছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর২০) শেয়ার প্রতি লোকসান ১.৭০ টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৪.৩৮ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) ২০১৫ সালে ছিল ১২.৯৬ টাকা, ২০১৬ সালে কমে ১২.৫৮ টাকা, ২০১৭ সালে আরও কমে ৬.৩৭ টাকা, ২০১৮ সালে ৭.২২ টাকা এভং ২০১৯ সালে আরও কমে ২.৮৫ টাকা দাঁড়ায়।

প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা পর্যালোচনা করে দেখা গেছ, ২০১৫ সালে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের নিট মুনাফা ছিল ২০ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার; ২০১৬ সালে নিট মুফা কমে দাঁড়ায় ১০ কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজার টাকা; ২০১৭ সালে মুনাফার পরিবর্তে লোকসান আগের দুই বছরের প্রায় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ কোটি ৭৭ লাখ ২ হাজার টাকা।

২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা হয় ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৩২ হাজার; তবে ২০১৯ সালে উল্টো লোকসান হয় ৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পাঁবছরের মুনাফা বা লোকসানের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৫,২০১৬ ও ১৮ সালে অর্থাৎ তিন বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা ৪৪ কোটি ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা এবং ২০১৭ ও ২০১৯ সালে বা মাত্র দুই বছরে নিট লোকসান হয়েছে ১০০ কোটি ৯৫ লাখ ২ হাজার টাকা।

দীর্ঘদিন লভ্যাংশ না দেওয়া লোকসানি ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার দর হু হু করে বাড়ছে। চলতি বছরের ৩ মে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর ছিল ৩.৩ টাকা। সোমবার (২৩ আগস্ট) প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের সমাপ্ত দর দাঁড়ায় ৯.৮ টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর বেড়েছে ৬.৫ টাকা বা ১৯৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লাল তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর কোনও কারণ ছাড়াই হু হু করে বাড়ার পেছনে কারসাজি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শেখ আসাদুজ্জামান নামের এক বিনিয়োগকারী। তিনি বলেন, কিছু দিন আগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্যদ ভেঙে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসইসি। নতুন এ পর্যদ এখনো পর্যন্ত ডিসেম্বরের আর্থিক প্রকাশ করতে পারেনি। এখন আগস্ট মাস চলে। নতুন বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিক তো বাদই দিলাম। সুতরাং কারসাজির জন্যই শেয়ার দর হু হু করে বাড়ছে।

এ বিষয়ে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জারিয়াব ঢাকা টাইমসকে জানান, শেয়ার দর কেন বাড়ছে সেটার কারণ আমরা জানি না। তবে আমাদের নতুন পর্ষদ গঠন করা। আমানতকারীদের অর্থ যথা সময়ে পরিশোধে গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের আস্থা ফিরেছে। নতুন পর্ষদের এ পর্যন্ত কয়টা মিটিং হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৬/৭ টি মিটিং হয়েছে।

ফারইস্ট ফাইন্যান্সের এমডি বলেন, চলমান কোভিড পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের খেলাপি ঋণের অডিট রিপোর্ট চূড়ান্ত করতে পারেনি। এছাড়া আমাদরে সাব-সিডিয়ার প্রতিষ্ঠানের পর্ষদও সম্প্রতি পরিবর্তন হয়েছে। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন আসেনি। এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলে আমরা সিএ ফার্ম দিয়ে অডিট করিয়ে ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবো। আমরা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে সময় প্রার্থনা করেছি। এবং তারা সেটি মঞ্জুর করেনে।

জানা গেছে, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের পরিমাণ ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকাই খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন গ্রাহক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জমা রয়েছে ৭৯০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে টাকা রেখে আটকে গেছে অগ্রণী, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্টসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে ফারইস্ট ফাইন্যান্স এখন খেলাপি হয়ে গেছে।

ফারইস্ট ফাইন্যান্স চলছিল মূলত চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভরসার একক নিয়ন্ত্রণে। আগে চেয়ারম্যান ছিলেন এম এ খালেক। তাঁদের সময়েই বড় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়। অনিয়মের কারণে চলতি বছরের ২৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

(ঢাকাটাইমস/২৪আগস্ট/আরএ/ডিএম)