‘রাজনীতি যেন গরিবের ভাবি’ ও জো বাইডেনের সহানুভূতির রাজনীতি

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২১, ১৪:২২ | প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫৯

২০০৭ সালের ১/১১ কেন এসেছিল? উত্তরটা খুবই সহজ: মনোনয়ন বাণিজ্য ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে সহানুভূতির রাজনীতিকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা। বিগত ১৪ বছর আমরা কি সেই দুরবস্থা থেকে উত্তরণ লাভ করতে পেরেছি? না, বরং সত্যিকার ত্যাগী নেতা- যিনি নিজের ঘুম হারাম করে, পরিবারের সুখ শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে, পরিবারকে সময় না দিয়ে, নিজের অর্জনকে সমাজকে বিলিয়ে দিয়ে সুখী হতে চেষ্টা করেছেন, জনকল্যাণে নিবেদিত সত্যিকার ত্যাগী সেই নেতাদের ক্ষমতার সিঁড়িতে নানা বাধা নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন বাণিজ্য রাজনীতির এক চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সারাদেশে। এই বাণিজ্য রাজনীতির ফলেই ঘটেছিল ৯/১১ এবং ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধ। আজ সেই যুদ্ধে রিক্ত হয়ে ফিরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুরা। সেখানে স্থান পেয়েছে সহানুভূতির রাজনীতি (Politics of Empathy)।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকামী জনগণ ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনকে নির্বাচিত করে রাজনীতিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনিভাবে ২০০৮ সালেও বাংলাদেশের জনগণ একটি সংসদ উপহার দিয়েছিল। উভয় বিজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সহানুভূতির রাজনীতি। আজ আমরা যে নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডারের (World Order) এর কথা শুনছি এবং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানোর যে কর্মযজ্ঞ দেখছি তার মূলে আছে এই সহানুভূতির রাজনীতি।

সহানুভূতির রাজনীতি মানে অন্যের চোখে দেখা, অন্যের কানে শোনা এবং অন্যের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা। তাই বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেকে তালেবানদের চোখে দেখেছেন। এবং সে অবস্থা থেকে উপলব্ধি করেছেন তালেবান তথা আফগানদের মনোভাব, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে। তাই তিনি দ্রুততম সময়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বিশ্বকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে চান। সহানুভূতি হবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালিকাশক্তি।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সহানুভূতির রাজনীতি চালু করেছিলেন এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করে শান্তি ও সহানুভূতির রাজনীতি চালু করেছিলেন। তিনি সেই সহানুভূতির রাজনীতিকে গ্রহণ করে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার ফল ভালো হয় না সেটা আমরা দেখেছি আমাদের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে। আমরা আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রাম ও যুদ্ধের কথা কম বেশি সকলেই জানি। আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে চালু করা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জিয়া ও এরশাদের রাজনীতি দেখেছি। তারা একদিকে সংগ্রামের ও সহানুভূতির রাজনীতির পথ বেয়ে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মাটিচাপা দিতে চেয়েছেন সামরিক ও বাণিজ্যিক রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করতে এবং সেটা এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে, বাংলার মানুষ ক্ষোভে গর্জে উঠে। আর তাই জাতীয় পার্টি ও বিএনপিকে হারাতে হয় অনেক কিছু। ধার করা আমদানিকৃত রাজনীতি ধর্মহীন সমাজতন্ত্র বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষ যেমন গ্রহণ করেনি তেমনি প্ৰত্যাখ্যান করেছে জামায়াত বা তাদের সমমনা দলগুলোকে। বাংলাদেশে যারাই বাণিজ্য রাজনীতিতে পা দিয়েছে তাদেরই পতন হয়েছে।

দিন দিন আবার যেন ধর্ম ও বাণিজ্য আমাদের রাজনীতিকে গ্রাস করতে বসেছে। আমরা কেবল করোনার কারণেই সংকটকাল অতিক্রম করছি না- বরং লক্ষ্য করছি রাজনীতিতে সহানুভুতির জায়গাটা যেন উবে গেছে এবং বাণিজ্য পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। আজ বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য উপদেষ্টা দুজনেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। সুতরাং রাষ্ট্রের রাজনীতিতে অর্থ ব্যাপক প্রভাব ফেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের হয়তো আশা ছিল রাজনীতিতে সহানুভূতির জায়গাটা থাকবে সবার ওপরে। সেই সহানুভূতি যেমন চীন, হংকং, তাইওয়ান এবং উইঘর জনগণের বেলায় দেখতে ব্যর্থ তেমনি ব্যর্থ ইসরাইল প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি কিংবা ভারত কাশ্মীরিদের প্রতি।

আগামী নির্বাচন যে অর্থ নিয়ন্ত্রণ করবে তা এখনই পূর্বাভাস করা যায়। সকল দলই চেষ্টা করবে ভোট কেনার প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করতে। সুতরাং বছরের পর বছর যারা জনগণকে সেবা দিয়েছেন তাদেরকে আমরা আর হয়তো পার্লামেন্ট, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ বা জেলা পরিষদে দেখতে পারবো না। আর তার পরিণাম আমরা সকলেই ভোগ করবো।

যে সহানুভূতির আন্তর্জাতিক রাজনীতি জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে চালু করার চেষ্টা করছেন তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে আশা করা যায়। সেজন্যই বাংলাদেশের যারা সহানুভূতির রাজনীতি করেন তাদের মনে আশা জেগেছে। যদি সেটি কাজ করে তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে বাণিজ্য ঢুকেছে সেখান থেকে মুক্ত হতে পারবে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদশের কথা বলি সেই আদর্শ আবার বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাতে সংযোজিত হবে।

আজ রাজনীতির আলোচনায় হাইব্রিড-কাউয়ার আগমন নিয়ে কথা শুনি। একজন সহানুভূতির হাইব্রিড বা কাউয়া ভালো? নাকি একজন বাণিজ্যিক চিন্তার রাজনীতিবিদ ভালো? নিজেকে প্রশ্নটা করা এখন খুবই জরুরি।

আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো বাণিজ্যিক সংস্থার তল্পিবাহক হয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে বের না হয়ে আসলে মানবতা পরাজিত হবে যা আমাদের কাম্য নয়।

আমাদের শিশুরা যেভাবে মাদক কিংবা টিক টক-এ আসক্ত হচ্ছে সেটা ওই বাণিজ্য রাজনীতির ফসল এবং এই কঠিন বাণিজ্য জাল থেকে মুক্ত করতেই আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। বাংলার রাজনীতিতে সহানুভূতিকে ফিরিয়ে আনতে তাই বঙ্গবন্ধুর আদশের সৈনিকদের দায় নিতে হবে এবং এখনই সেটা শুরু করতে হবে।

সহানুভূতি থেকে যারা রাজনীতি করে তাদেরকে স্থান করে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও বর্তমান শাসকদের উপরও বর্তায়। সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সুশীল সমাজের ভূমিকা আছে। আমরা রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের স্থান করে দিয়েছি সামান্য কিছু পেয়ে। কিন্তু তারা তাদের পদকে ব্যবহার করে লাভবান হওয়ার প্রতিযোগিতা করছেন কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আচার্য আবদুল হামিদ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সমস্যাটিকে একথা বলে- ‘রাজনীতি এখন গরিবের ভাউজ (ভাবি)’। তিনি আরও বলেছিলেন, “এখানে যে কেউ যেকোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। কোনো বাধাবিঘ্ন নেই। আমি যদি বলি আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিকসের লেকচারার অইতাম চাই বা প্রফেসর অইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে ঢুকাইতো না।” তিনি বলেন, “কই যাইবেন, রাজনীতি আসলে হয়ে গেছে গরিবের ভাউজ। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বিজনেসম্যানরা তো আছেই। শিল্পপতি, লগ্নিপতিদের আগমন এভাবেই হয়ে যায়। কী করবেন? এগুলোকে থামানো দরকার।” কিন্তু সেটা আমরা ভুলে যেতে বসেছি। সকল রাজনৈতিক দলের এখানে একমত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে যারাই বাণিজ্য রাজনীতিতে পা দিয়েছে তাদেরই পতন হয়েছে। সুতরাং সঠিক পথে ফেরার সময় এখনই। সহানুভূতির রাজনীতি হোক আমাদের অন্যতম আদর্শ।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :