সুখী পিরাণে দুঃখ ঢাকা

মোরশেদুল জাহের, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫২ | প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট ২০২১, ১২:৪৩

বন্ধুটি খুব মনমরা চেহারায় এল আমার অফিসে। তাকে এমন চেহারায় আগে কখনো দেখিনি। দীর্ঘদিনের চেনা পরিপাটি-হাসিখুশি বন্ধুটির সঙ্গে আজকের মানুষটি বড় বেমানান। পরাজয়ের ক্লান্তি চোখে-মুখে, দেহভাষায়। তাকে দেখে আমি হাসিমুখ করতে যেয়ে সামলে নিই।

চেয়ারে বসে টেবিলের দিকে মুখ নুইয়ে নীরব থাকে বন্ধু। অনাগত শঙ্কার দ্বন্দ্বে আমি কিছু বলি না। একটু সময় নিয়ে তারপর উঠে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখি। বলি- ‘কী হয়েছে তোর, কোনো সমস্যা!’ ও মুখ তুলে তাকায়। থমথমে মুখাবয়ব। নিষ্প্রভ দৃষ্টি। অলস ভঙ্গিতে দুটি হাত টেবিলের ওপর রাখে। রাখতে রাখতে দূরাগত কণ্ঠে বলে, ‘সৎ থাকা আর কম্প্রোমাইজ কি অপরাধ?’

আমি তার হাতটা ধরি।

অঝরে কেঁদে ওঠে বন্ধু, ‘অযোগ্য পাত্রে কমপ্রোমাইজ করে আর ভুল জীবনবোধের চর্চাকারীকে ছাড় দিয়ে দিয়ে আমি নিঃস্ব হয়েছি অনেক আগেই, এখন কলঙ্কিত হচ্ছি প্রতি বেলা।’

প্রায় ১০ বছর পর এসেছে বন্ধুটি। আগেও মাঝে মাঝে আসত। আজ ওর গল্প শোনার পর বুঝতে পারি তখন যে মাঝে মাঝে আসত, সেটা ছিল ওর নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নেওয়ার জন্য আসা। ভেতরে ক্ষোভের আগুনে উত্তাল মেজাজ আর দুঃখের দহনে কুঁকড়ে যাওয়া মনকে প্রশমন করার জন্য আসা। কিন্তু তখন আজকের মতো এমন করে কিছু বুঝতে দেয়নি আমাদের। এতটা বছর তুশের ভেতর ধিকি ধিকি জ্বলে গেছে ও প্রতিদিন।

স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে বন্ধুর সংসার। স্ত্রীর চাপ-মনোভাব ও বোঝে। সংসারের শান্তির জন্য মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন স্বজনবৎসল বন্ধুটি। ভাই-বোনেরা জানে তাদের ভাইটি চাকরির কঠোরতা আর ব্যস্ততার জন্য তাদের সময় দিতে পারে না। তাদের পরামর্শ- ‘তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করো না। তুমি ভালো থাকলেই আমরা খুশি। শুধু মাঝে মাঝে একটু ফোন দিও।’

স্বজনদের এই প্রশ্রয়কে আত্মসান্ত্বনা মানে বন্ধুটি। অফিস ও বাসা হয় তার জীবনের পরিধি। আত্মীয়, বন্ধুও সমাজের সবকিছুতে ওর প্রবল অনুপস্থিতি থেকে আমরা বুঝতে পারি, স্ত্রী-সন্তান আর সংসারে মগ্ন হয়েছে সে। এ নিয়ে আমরা তাকে ঘাঁটাই না। ও ওর মতো ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। আমরা বন্ধুরা এখনো নানা উপলক্ষে আড্ডা দিই, বেড়াতে যাই, তাকে সেভাবে দেখি না কখনো।

এখানে সেসব আর না বলি। শুধু বলে রাখি, ঘরে মানুষজন আছে, গেরস্থালির সব আয়োজন আছে, কিন্তু সংসারকর্ম বলতে যে ছবিটা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তা নেই বন্ধুর ঘরে। শ্বশুরবাড়ির দু-তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না সেটা। আশপাশের প্রতিবেশীরা উচ্চমার্গীয় শব্দের কারণে কেউ কেউ জেনে থাকলে থাকতে পারে। ওসব অনেক দীর্ঘ কাহিনি। কষ্টের ও যাতনার। সেসব থাক এখন। কারণ বন্ধুটি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখী মানুষ, এই রঙিন পিরাণ ঝুলে থাক । বরং মূল বয়ানে আসি।

বন্ধুটি তার প্রথম সন্তান আর শিক্ষিত স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পাতে ভাড়া বাসায়। নতুন জীবন। ঘরের কাজে সহযোগিতার জন্য স্ত্রী তার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসে বছর দশেকের এক বালিকাকে। অবসরে বন্ধু তার ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে খেলা করে, গৃহকর্মী শিশুটিও যোগ দেয় মাঝে মাঝে। তখন তার উচ্ছলতা দেখে মনে হয় না সে গৃহকর্মী। বন্ধুটি ভাবে, কোন সুদূরে বাবা-মা ফেলে এসেছে মেয়েটি, থাকুক সে হাসি-আনন্দে। বন্ধুর এই উদারতা অন্যদিকে রচনা করে শ্যেন দৃষ্টি। যোগ-বিয়োগের হিসাব-নিকাশ।

কদিন বাদে এই ছোট্ট মেয়েকে জড়িয়ে বন্ধুকে যাচ্ছেতাই চিত্রায়িত করে স্ত্রী। শিশুটির সঙ্গে তার বাজে সম্পর্ক আছে- এমন প্রমাণ খোঁজার জন্য স্ত্রীর একদিনের আচরণে সে বুঝেছিল এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষের আচরণ না। মিথ্যা সন্দেহে, যুক্তিবোধের বাইরে একটি ছোট্ট মেয়েকে জড়িয়ে স্ত্রীর এমন অস্বাভাবিক আচরণ বন্ধুর ভবিষ্যৎ জীবনের ভাবনাকে ধোঁয়াশা করে দেয়। আগে থেকে এটা-সেটা নিয়ে ঝগড়া ছিলই, মেয়েটিকে নিয়ে এরপর কী সব একেকটা দিন কাটে, তা ভাবলে ওর গা শিউরে ওঠে।

মিথ্যা নারীসম্পর্ক নিয়ে অপবাদ আর দুঃসহ জীবনের দ্বিতীয় ঘটনার সূত্রপাত রাজধানীর একটি হাসপাতালে। ফুসফুসের অসুখ নিয়ে ওই হাসপাতালে কয়েক দিনের জন্য ভর্তি ছিল বন্ধুটি। সেবাসঙ্গী স্ত্রী। আত্মীয় পুরুষ সঙ্গী থাকবে বলা হলেও সে হাসপাতাল ছাড়তে রাজি নয়। হাসপাতালে বন্ধুকে দেখতে আসা অনেকের সঙ্গে স্ত্রীর প্রথমবারের মতো পরিচয়। বন্ধুগোছের কেউ কেউ মজা করে- ‘ভাবী, ভাইকে কিন্তু দেখে রাখবেন।’ স্ত্রী হাসে, কিন্তু তার আড়ালে রোপণ করে বিষবৃক্ষ। কোনো বন্ধু বললেন হাসপাতালের অমুক ডাক্তার কিংবা নার্স তার পরিচিত। প্রয়োজনে যেন তাকে জানায় বন্ধু। তাও কাল হলো একদিন।

সেদিন দুপুরবেলা হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে পানি কিনতে যায় স্ত্রী। এর কিছুক্ষণ পর কোনো এক কাজে ক্যাবিনে আসে একজন মধ্যবয়সী নার্স। চিকিৎসাকাজে বন্ধুর গায়ের টিশার্টটি খুলতে হয়েছিল হয়তো। তখনই স্ত্রী এসে দেখে নার্স বিছানার সামনে দাঁড়ানো, বন্ধুটির কাঁধে টিশার্ট। হাসপাতালের পরের দিনগুলো তার জন্য হয়ে ওঠে এক জ্বলন্ত নরক। স্ত্রীর দাবি- ওই নার্স তার বন্ধুর সেই পরিচিত নার্স; এ জন্যই এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, তার সঙ্গে বন্ধু অবৈধ সম্পর্ক। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। জীবন-মরণ যা হোক, হাসপাতাল ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা ভাবে বন্ধু। ওই নার্স নিয়ে স্ত্রীর গঞ্জনা হাসপাতাল ছাড়ার পর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অন্য আরও নানা যন্ত্রণার সঙ্গী হয়। বন্ধুটি তখন একটি স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে চাকুরে। সন্তান কলেজে পড়ে। স্ত্রীর তাড়নায় তাকে সন্তানের কলেজ থেকে ফেরা পর্যন্ত বাসায় থাকতে হয়। কারণ সন্তান এলে পরে বন্ধুকে স্ত্রীর কিছু কাজ করতে হবে, আগে করা যাবে না। ফলে বিলম্বে অফিসে যাওয়া প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। আবার অফিসে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সন্তানকে দিয়ে স্ত্রীর ফোন- তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে, এখনই যেতে হবে। রোজ রোজ জরুরি তাগাদা। কিন্তু জরুরি কাজটি বাসায় গিয়ে পায় না বন্ধু।

স্ত্রীর এই আচরণের কারণটি মেলে মাস কয়েক পর। তার বিশ্বাস বন্ধুটি অফিসে মেয়েদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা দেয়, অফিস ফেলে কোথায় গিয়ে সময় কাটায়। তাতে আছে ওই নার্সও। এভাবে বন্ধুর স্ত্রী মিথ্যা নারীসঙ্গের অপবাদ আর খিস্তিখিউরে তাকে জর্জরিত করে প্রতিনিয়ত। বন্ধুটির অফিসের কাজে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না ঠিকমতো। পরিপাটি বন্ধুটিকে সহকর্মীরা প্রায়ই দেখে বিস্রস্ত। সময়ানুবর্তিতায়ও এলোমেলো দেখা যায় ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার পাওয়া বন্ধুটিকে।

কিছুদিন পর বাড়ি বদলায় বন্ধু। সেখানে একজন পয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের বয়সী নারীকে বাসার ছোটা কাজে রাখে স্ত্রী। মাস যেতে না যেতে স্ত্রীর হিসহিস। মহিলা ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে এসেছে, লিপস্টিক দিয়ে এল কেন? লিপস্টিক কোথায় পেল? স্ত্রী নিশ্চিত সে এসব পেয়েছে বন্ধুর কাছ থেকে! তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক বলতে হবে বন্ধুকে।

তাকে বোঝানোর সাধ্য হয় না বন্ধুর। কী যে পীড়াদায়ক একেকটা রাত, একেকটা দিন যায় বন্ধুটির জীবনে! যখন ফজরের আজান হয়, ভোরের আলো ফুটতে থাকে, ক্লান্ত হয় স্ত্রীর খিস্তি-খেউড়। কতবার সব ছেড়েছুড়ে গৃহত্যাগী হওয়ার কথা মনে আসে বন্ধুর। সন্তানের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় বারবার। সন্তানকে আগলে বলে, এসব নিয়ে মনে কোনো চাপ নেয় না যেন সে। পীড়িত বন্ধুটি বহু দিন, বহু গভীর রাত রাজধানীর পথে পথে ঘুরেছে একা। কখনো রিকশায়, কিংবা হেঁটে। প্রায় নির্জন গভীর রাতে জোসনা, অমাবস্য, শুক্ল বা কৃষ্ণপক্ষ- কত কত রাত। দুয়েকবার দূরের শাহজালাল বিমানবন্দরের দর্শনার্থী লাউঞ্জে টিকেট কেটে সেখানে কাটিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে তীরে হেঁটেছে দুর্বহ গ্লানি নিয়ে। লজ্জার মাথা খেয়ে রাতবিরাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠেছে কখনো। রাগে-ক্ষোভে কত দিন ঘর ছেড়ে কলিগ কিংবা কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়ে থেকেছে, সেই হিসাবও ছোট নয়।

দুঃখক্লান্ত বন্ধুটি তখন কোনো দেবদূতের বরের অপেক্ষা করে, হয়তো একদিন সাদা আলখেল্লা পরা শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত দেবদূত গমগমে গলায় দিশা দিয়ে যাবে তাকে। সুস্থির হবে সংসার। এরই প্রতীক্ষায় হর্ষ-বিষাদের বর্ম পরে সমাজে কৃত্রিম হাসিমুখ করে থাকে বন্ধুটি। জীবনকে ছেড়ে দেয় সময়ের কাছে।

মাঝখানে বেশ কিছু শীত আর গ্রীষ্ম শেষে আবার গৃহকর্মী। এবারের ঘটনা শোনা যাক বন্ধুর মুখে। থাক, আমার বয়ানে বলি। বন্ধুটি বর্তমানে যে বাসায় আছে, সেখানকার ঘটনা। গত বছরের মার্চে করোনার প্রকোপ বাড়লে বাসার ছোটা কাজের মহিলাকে বিদায় দেয় বন্ধু। করোনার প্রকোপ কমে এলে ডিসেম্বরে স্ত্রী তাকে জানায়, ঘরের কাজের জন্য একটা মেয়েকে আনা হচ্ছে ঢাকার বাইরে থেকে। তাকে পুরনো দিনের গ্লানির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বন্ধু অনেকটা অসম্মতি জানায়।

যা হোক, জানুয়ারির শুরুর দিকে একদিন বন্ধু অফিস থেকে ফিরলে স্ত্রী জানায়, মেয়েটিকে বাসায় নিয়ে এসেছে। বছর পনেরোর এক কিশোরী। তাদের কোনো এক আত্মীয়ের মেয়ে। বন্ধুটির মনে অনাগত বিড়ম্বনার হাতছানি একপশলা কাঁপন তুলে যায়। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আত্মার কাকুতি নিয়ে- আল্লাহ, আমার ইজ্জত-সম্মান হেফাজত করো।

প্রথম দিকে দিন কয়েক এমন ছিল যেন বন্ধুর স্ট্যাটাস গৃহকর্মীটির নিচে। হয়তো আত্মীয় বলে! মাস দেড়েক ভালোয় কাটে। এরপর বদলাতে থাকে আবহাওয়া। ঘরজুড়ে স্ত্রীর শ্যেনদৃষ্টি। স্ত্রীর ছায়া মেয়েটিকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। বন্ধুর এত দিনের চলাচলের সীমানা কমতে থাকে। হাত-পায়ের নড়াচড়া মাপা হয় নিক্তিতে। যার দিন শুরু হয় বেলা ১২টার পর, সেই স্ত্রী এখন সকাল আটটা থেকে ঘুরঘুর করে ঘরময়। তার নিয়মিত দীর্ঘ ঘুম দরকার, নিয়মিত ভালো ঘুম ওকে মানসিকভাবে সুস্থির রাখে, সেটা জানে বন্ধুটি। তাই স্ত্রীর বেলা করে ঘুমানো মেনে নিয়ে সংসারের আয়োজন অন্যভাবে সেরে নেয় বন্ধু।

কিন্তু মেয়েটি আসার পর এখন সেসব এলোমেলো। তবু বন্ধুটি স্ত্রীকে বলে, ‘এখন তোমাকে আদর্শ গৃহকর্ত্রীর মতো লাগছে।’ জবাবে কী যেন বলে স্ত্রী, তা বুঝতে পারে না বন্ধু। বন্ধুটি সতর্ক হয়। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বারবার বলে যায়- ‘সতর্ক হও, সতর্ক হও! তোমার প্রাত্যহিক জীবনের নিয়মিত কাজগুলোও এখন স্ত্রীর কাছে অন্য অর্থ হতে পারে।’ নিজের স্বাভাবিক জীবনাচার ও অভ্যাসগুলোতে বেড়ি বাঁধতে থাকে বন্ধু। পা ফেলতে গিয়ে পারলে গজ-ফিতায় মেপে নেয়। সেলফ থেকে জুতা নেওয়া এবং পায়ে পরার সময় সতর্ক থাকে ঘাড় কতটা কাত হলো। বন্ধু যেন নিজ ঘরে পরবাসী।

দিন সাতেকে স্ত্রীর ভাবসাব আরও একটু গুমোট হয়। বন্ধুটি তার স্ত্রীকে বলে, ‘তুমি বোধহয় কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছ, কম ঘুমাচ্ছ। অহেতুক নিজের সমস্যা বাড়িও না।’ স্ত্রী কটমট করে তাকায় বন্ধুর দিকে। আরও দিন কয়েক পর অবস্থা দৃষ্টিকটু রকম হয়ে উঠলে, স্ত্রীকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় বন্ধু। এক-কথা দু-কথা শেষে বন্ধুর স্ত্রীর গত কদিনের রুদ্ধ চেহারা বেরিয়ে আসে। মেয়েটিকে জড়িয়ে আদিরসাত্মক অভিযোগ উগড়াতে থাকে কণ্ঠে। সন্তান ও মেয়েটিকে শুনিয়ে রাতদুপুরে কী সব ভয়ানক কথাবার্তা! মেয়েটির নানা সন্দেহজনক আচরণের উদাহরণ হাজির করে স্ত্রী। বন্ধুর চরিত্র এবার কালিমালিপ্ত হয় সোমত্ত সন্তানের সামনে।

শালীন মাত্রার দুয়েকটা উদাহরণ আমরা দেখে নিতে পারি। মেয়েটি নাকি কখন একবার ভেতরের রুমে গুন গুন করেছিল, তার ৪০ সেকেন্ড পর ডাইনিং টেবিলে বন্ধুটিও নাকি গুনগুনিয়ে ওঠে। সিনেমার দৃশ্যের মতো গানে গানে কী কথা হয়েছে, জিজ্ঞাসা স্ত্রীর। বন্ধুটি বাইরে থেকে ফিরে দরজায় নক করলে মেয়েটি নাকি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। কেন? বন্ধু খেতে বসলে সে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। কেন? আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকি `স্টাইল‘ করে মেয়েটি।

বন্ধু এসবের কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না! তবু দেয়। আচ্ছা এমন তো হতে পারে, হয়তো মেয়েটি এখানে ভালো আছে, ভালো পরিবারে আছে ভেবে মনের অজান্তে গুনগন করেছে। তার গুনগুন যদিও বন্ধু শোনেনি আদৌ। আর শত সুখ-দুঃখে বন্ধুটির মাঝে মাঝে খানিক গুনগুন করে ওঠা স্ত্রীর অজানা নয়। খাবার সময় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হতে পারে বন্ধুটি কিছু চাইতে পারে। দরজা খুলতে দেরি হলে ধমক খেতে পারে, এ জন্য হয়তো দ্রুত যায়। দরজা দেরিতে খোলার কারণে বন্ধুর স্ত্রী কিংবা সন্তানের প্রতি উষ্মা প্রকাশের ঘটনা দেখেছে মেয়েটি। এসব যুক্তি অরণ্যে রোদন হয় কেবল।

দুই-আড়াই দশকের দাম্পত্য জীবনে প্রতিনিয়ত এমন সব গঞ্জনা সয়ে যায় বন্ধু। এই বয়সে এসে তা আর নিতে পারছে না। নিজের জীবনবোধ, বিলাস-ব্যসন বিসর্জন দিয়ে বন্ধু সংসার টেনেছে সন্তান আর সমাজের দিকে চেয়ে। এখন বুঝতে পারে, এই সেন্টিমেন্ট আদপে বোকার ধর্ম, কাপুরুষের আত্মবিলাস। সন্দেহবাতিকতা, অবিশ্বাস আর অশ্রদ্ধার মাঝে সম্পর্ক ধরে রাখা, কম্প্রোমাইজ করে চলা মানে দিনে দিনে কঠিন মূল্য দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া। দিনে দিনে সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করে কম্প্রোমাইজের ক্যাকটাস ধারালো কাণ্ড মেলে ঋজু হয় কেবল। বহির্মুখিতা আর পরনারীসঙ্গ থেকে সারা জীবন দূরে থাকা আত্মনিয়ন্ত্রিত বন্ধুটি স্ত্রীর কাছ থেকে বারবার মিথ্যা অপবাদে জর্জরিত হয়ে এখন আত্মমূল্যায়নে আছড়ে পড়ছে। যাপিত ভালোমানুষি জীবনের বদলে ঘরে-বাইরে আনন্দ-ফুর্তি করে ভালো মানুষ সেজে থাকলে বোধহয় এত কষ্ট হতো না তার। যেহেতু সে তা নয়, সরল নৈতিকতার অহমিকায় দঢ় বন্ধুটি কষ্ট-অপমানে বিস্ফারিত হয়। দেহ-মন-মস্তিষ্ক জুড়ে ঘৃণার দলা পাক দিয়ে ওঠে। অদ্ভুত এক রক্তচাপ জমে শিরা-উপশিরায়। স্পাইনাল কর্ড সারা দেহে এক অচেনা অনুভূতি ছড়িয়ে দেয় সারাক্ষণ। অস্থির লাগে। মনে হয় কখন না আবার দেহের নিয়ন্ত্রণ হারায় সে।

পেছন ফিরে দেখে বন্ধু, সে জ্ঞানত ক্ষতি করেনি কারও। কারও চরিত্র নিয়ে পরচর্চা কিংবা গীবত করেনি কখনো। অথচ জীবন নিয়ে তার সুন্দর ও প্রাণময় স্বপ্নগুলো কাছের মানুষের মিথ্যা অপবাদে ভেঙেছে কতবার কতভাবে! বারবার ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে নতুন স্বপ্ন বুনে। অলক্ষ্যে কেউ একজন বুঝি তা চায়নি। তাই তার সুস্বপ্ন ছাওয়া জীবনবোধে সুখের দিশা মেলেনি। তার পরও আরেকটা জন্ম পেলে সে তার এই জনমের চর্চিত জীবনবোধ ও নৈতিকতাই ফিরে চাইবে। শুধু ওই জনমে এবারের মতো দহন বাড়তে দেবে না, বেদনার তুশ পুষে রাখবে না আর। মুক্তির কত পথ খোলা চারপাশে, তার কোনোটি বেছে নেবে সে আয়েশে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :