পিকে হালদারের মামলার তদন্ত কোন পর্যায়ে?
প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ নিয়ে কানাডায় পলাতক প্রশান্ত কুমার ওরফে পিকে হালদার। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই ডজনেরও বেশি মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও অন্তত কয়েক ডজন মামলার প্রস্তুতি চলছে।
পিকে হালদারের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক তদন্ত করছে। দুদক ও বাংলাদেশে ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলেজন্স ইউনিটের পক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা ঋণ নিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। কাগুজে ও নাম সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে কোনো মর্টগেজও রাখা হয়নি।
দুদকের তদন্ত সশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কাগুজে যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিকে হালদার মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন সেইসব প্রতিষ্ঠানে তার সহযোগীদের কাউকে চেয়ারম্যান, কাউকে এমডি, আবার কাউকে ডিরেক্টর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই ক্ষেত্রে নিজে থেকেছেন অনেক ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিনিময়ে তিনি তাদের বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ আর্থিক সুবিধা দিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
পিকে হালদারে বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ২৭৪ কোটি টাকা ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকা সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছিলেন দুদকের উপ পরিচালক মো. সালাউদ্দিন। এই তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি তার বিরুদ্ধে যে মামলাটি করেছিলাম সেটির তদন্ত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া তার বিষয়ে দুদকের আরও অনুসন্ধান টিম কাজ করছে।’
পিকে হালদারে আর্থিক অনিয়মরে বিষয়ে অনুসন্ধানে কাজ করছেন দুদকের এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পিকে হালদারে বিরুদ্ধে মামলা আর অভিযোগের অন্ত নেই। অনুসন্ধান করতে গিয়ে একের পর এক নতুন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত অনেকাংশে অগ্রগতি হয়েছে। পিকে হালদার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এই অবস্থায় কাজ একটি জায়গায় এসে স্থবির।’
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পিকে হালদারসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি মামলা দায়ের হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুয়া পাঁচটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এই অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি রাশেদুল হক আদালতে ১৬৪ ধারায় অর্থ আত্মসাতে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এছাড়া আরও দশটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভূয়া ঋণপত্র দেখিয়ে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কানাডা পলাতক পিকে হালদারসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে দুদক ১০টি মামলা দায়ের করে চলতি বছরের মার্চে।
দুদকের অনুমোদিত ওই ১০ মামলা থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৪৯৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পিকে হালদারসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রজু করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সাবেক এমডি মো. রাশেদুল হক, বর্তমান চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, ভারপ্রাপ্ত এমডি মো. আবেদ হোসেনকে আসামি করা হয় এসব মামলায়।
পিকে হালদারের দুর্নীতির অভিযোগের তলব, জিজ্ঞাসা, মামলা এই তিন কর্ম সারার পর দুদক তার বিষয়ে কতটা তৎপর? ইন্টারপোলের মাধ্যমে পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করতে যে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, সেই বিষয়ে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজ্জাম্মেল হক খান বলেন, এই বিষয়ে এখনও কোনো আপডেট তথ্য তাদের কাছে নেই।
এর আগে চলতি বছরে জুলাই ঢাকা টাইমসের সঙ্গে ফোনালাপে দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শুনেছি। কোভিড পরিস্থিতির কারণে সারা পৃথিবী স্থবির হয়ে আছে। আমরা আশা করছি অফিস শুরু হলে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরানোর কি ধরনের অগ্রগতি হয়েছে, তা গণমাধ্যমকে সুর্দিষ্টভাবে জানাতে পারব।
১০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ
পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের যোগসাজশে ফাস ফাইন্যান্স থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। দুদক সূত্রে জানা যায়, ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে। উল্টো ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত বা মর্টগেজও গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষা থেকে জানা যায়, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৭৩ শথাংশ। পি কে হালদার তার বেনামি ৯ কোম্পানির নামে ফাস থেকে ঋণের ১ হাজার ১১৮ উত্তোলন করে আত্মাসৎ করেন। এছাড়া ফাস ফিন্যান্স থেকে বাকি যে ঋণ গিয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেগুলোর সঙ্গেও পিকের হাত আছে বলে ধারণা করছে দুদক।
বিভিন্ন হিসাবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কথা বলা হলেও দুদকের কাছে দেওয়া বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য থেকে জানা যায়, চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশান্ত কুমার হালদার সরিয়েছেন ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বিএফইইউর তথ্যমতে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এফএএস) থেকে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরান পি কে হালদার চক্র ।
পি কে হালদারসংশ্লিষ্ট নয়জন গ্রেপ্তার
পি কে হালদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়জন এখন পর্যন্ত দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। চলতি বছরে ৪ জানুয়ারি দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পি কে হালাদারের অন্যতম সহযোগী শংখ বেপারিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, পি কে হালদারের সম্পদ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন জনের কাছে রয়েছে, সেখানে তিনি সহায়তা করেছেন। এছাড়া তার দখলে ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। এটা পি কে হালদারের অর্থে কেনা হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
বেশ কয়েকবার দুদক তলব করলেও জবাব দেননি পিকের সহযোগী অবন্তিকা বড়াল। পরে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে অবন্তিকা বড়ালকে গেপ্তার করা হয়। ২৫ জানুয়ারি তাকে প্রথম দফায় তিন দিনের রিমান্ডে নিলে পি কে হালদারের দেওয়া একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের তথ্য পায় দুদক, যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে চাড় কোটি টাকা।
দুদক জানায়, ধানমন্ডি ১০ নম্বর রোডের তিন হাজার বর্গফুটের যে ফ্ল্যাট অবন্তিকা থাকতেন, সেই ফ্ল্যাটের মূল্য নগদ ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন পি কে হালদার। এ ছাড়া ‘সুখাদা’ লিমিটেড নামে যে কোম্পানিটি অবন্তিকা পরিচালনা করতেন, সেটির বিনিয়োগও পিকের।
অবন্তিকার পর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে পি কে হালদারের আইনজীবী হিসেবে পরিচিত তার অন্যতম সহযোগী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে। এদিন সংস্থাটিতে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরই দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন তাদের গ্রেপ্তার করেন।
দুদকের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় মোট ১২২ জনের বিদেশযাত্রায় যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়ে, সেই তালিকায় নাম ছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীরও। দুদকের ডাকে জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হলে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকেও একইদিনে অর্থাৎ ২১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে দুদক।
একই অভিযোগে এ বছরের ১৬ মার্চ দুকের হাতে গ্রেপ্তার হন পি কে হালদারের আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভাইস চেয়ারম্যান নাহিদা রুনাই। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান ও সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী।
অগ্রগতি নেই ইন্টারপোলের কাজের
পলাতক পিকে হালদারকে দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়ার কথা জানা গেছে। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগিতর সুখবর দিতে পারেনি সংস্থাটি এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠছে- আসলেই কি কোনো কাজ করছে ইন্টারপোল?
গত বছর পিকে হালদারকে বিদেশ থেকে ফেরত আনতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছিল হাইকোর্ট। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করতে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেন। হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রক্ষিতে অনুসারে দুদক গত বছরের ২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে।
ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর পিকে হালদারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চায় হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করতে যে মামলা করা হয়েছে তার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়। দুদকের আইনজীবী আদালতকে জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পিকে হালদারের গ্রেপ্তারের পরোয়ানা ইন্টারপোলকে পাঠানো হয়েছে।
ইন্টারপোল কি কাজ করেছে-এমন প্রশ্নে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (ইন্টারপোল) মো. মহিউল ইসলামকে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করতে যে রেড এলার্ট জারি করার কথা সেটা আমার করেছি। কানাডা পুলিশের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। আমরা আমাদের পার্টটুকু করেছি, বাকি কজটুকু করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ও দুদক।’
গত ২০২০ সালের মার্চ থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সবকিছু স্থবির। অফিস-আদালত বন্ধ। এই সময়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন দুদকের অনেক কর্মকর্তা। করোনা সংক্রমিত হয়ে মহাপপরিচালসহ মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। যে কারণে গত দেড় বছর দুদকের কাজের গতি অনেকটাই হারিয়েছে বলে মনে করেন দুদকের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা।
(ঢাকাটাইমস/০৩সেপ্টেম্বর/এসআর/ডিএম)