থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ নিয়ে স্যারের অনেক স্বপ্ন ছিল

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৫

ডা. নুসরাত সুলতানা

একজন ড. সাইয়েদ সালেহীন কাদরী স্যার (প্রাক্তন অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি ও মলেকিউলার বায়োলজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। ২০১৫ সালে স্যারের সাথে পরিচয় আইদেশীতে ( institute for developing science and health initiatives)। আমি সেখানে তখন পিএইচডি রিসার্চের কাজ করতাম। মাঝে মাঝে সেখানে আসতেন স্যার৷ আমাদের সাথে অনেক গল্প করতেন। সবই অনুপ্রেরণামূলক গল্প। অসম্ভব হাসিখুশী, আমুদে, মানবদরদী, পিতৃসম মানুষ ছিলেন তিনি।

স্যারের ব্যাকগ্রাউন্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলেকিউলার বায়োলজি হলেও মেডিকেল সায়েন্সের প্রতি ছিল অগাধ আগ্রহ, বিশেষ করে জেনেটিক রোগের প্রতি। প্রতিরোধযোগ্য জীনগত রোগ নিয়ে তিনি সবসময়ে ভাবতেন।

একবার স্যারকে আমরা সবাই অনুরোধ করলাম নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন আসার জন্য। স্যার খুশীমনে রাজী হলেন এবং উনি প্রস্তাব দিলেন নির্দিষ্ট যেদিন তিনি আসবেন সেদিন জার্নাল ক্লাব হবে অর্থাৎ আমরা একেকজন সেইদিন বিখ্যাত কোনো জার্নাল থেকে সায়েন্টিফিক পেপার প্রেজেন্ট করব।

প্রথম জার্নাল ক্লাবের শুরুতে স্যার আমাদের Ted Talk দেখালেন। Ted Talk হচ্ছে অনুপ্রেরনামূলক প্রেজেন্টেশন। জার্নাল ক্লাব শেষে আবার সেই পেপার নিয়ে আলোচনা, গল্প আর চা খাওয়ার পর্ব। প্রতি জার্নাল ক্লাবের আগেই স্যার টেড টক দেখাতেন। কখনও শাহরুখ খানের কখনও ইলন মাস্কের, কখন ও বা কোন ক্যান্সার সারভাইভার অথবা বড় দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসা কোন মানুষের।

আমি ভাইরোলজিস্ট হলেও আমার পিএইচডির টপিক ছিল থ্যালাসেমিয়া। স্যার ও থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন থাকতেন। নিজ উদ্যোগে থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গিয়েছেন। রোগীদের দূর্দশা নিজ চোখে দেখেছেন, শুনেছেন। স্যারের কোমল মন ব্যথিত হয়েছে আক্রান্ত মানুষদের দুরবস্থা দেখে। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে শুরু করলেন ব্যপক পড়াশুনা। আমাদের সাথে আলোচনা করতেন। এরপর স্যার আইদেশীতে সপ্তাহে একবারের জায়গায় দুইদিন আসা শুরু করলেন।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার প্রিভ্যালেন্স নিয়ে ৯০ এর দশকের পর থেকে কোন রিসার্চ হয়নি ২০১৭ সাল অব্দি। স্যার আইদেশীর হেড ড. কায়সার মন্নুর ভাইকে বললেন আমাদের সাথে নিয়ে একটা প্রজেক্ট লিখতে। এরপর প্রোজেক্ট লেখা নিয়ে স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ আরো বেড়ে গেল।  যে ইন্সটিটিউটে আমরা স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য যেতাম, সেখানেই স্যার থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ নিয়ে একটা অসাধারণ প্রেজেন্টেশন দিতেন। সফলভাবে প্রোজেক্ট সম্পন্ন হলো। আন্তর্জাতিক নামকরা জার্নালে তা পাব্লিশও হলো।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করার জন্য ডা. মাহফুজুর রহমান রাজ ভাই এর উদ্যোগে সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এবং বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর চেয়ারম্যান সিরাজুল খান স্যারের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন মিলে ‘’ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠনের গোড়াপত্তন করলাম ২০১৭ তে। কাদরী স্যারকে অনুরোধ করার সাথে সাথে তিনি এই গ্রুপের সদস্য হতে রাজী হলেন। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগে জুমে একটা মিটিং এ স্যার থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের বিষয়টি নিয়ে কিভাবে এগোনো গেলে সফলতা দ্রুত আসবে এ বিষয়ে  অনেক দিক নির্দেশনা দেন।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ নিয়ে স্যারের অনেক স্বপ্ন ছিল। সফলতা হয়তো একদিন আসবে। কিন্তু স্যার নিজ চোখে দেখে যেতে পারলেন না। সর্বনাশা কোভিড-১৯ এর সাথে যুদ্ধ  করে একমাস লাইফ সাপোর্টে থেকে আজ ভোরে পরাস্ত হলেন এক মহান প্রান।

স্যারের স্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এমিরিটাস সায়েন্টিস্ট (আইসিডিডিআর বি) ড. ফিরদাউসি কাদরী সম্প্রতি সম্মানজনক ম্যাগসেসাই এওয়ার্ড অর্জন করেছেন। আর আজ স্যার আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন কত দূরে।

তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও যে কজন শিক্ষকের আদর্শ আমি অনুসরণ করি, যাদের জন্য সবসময়ে আল্লাহপাকের কাছে বিশেষভাবে দোয়া করি স্যার সেই ক্ষুদ্র বিশেষ দলেরই একজন।

স্যারের সাথে কত শত গল্প, কত মধুর স্মৃতি, বলে শেষ করা যাবে না। বিষাদে ছেয়ে আছে মন। আমি জানি স্যারের সাথে যিনি একদিন কথা বলেছেন, তারও মন আজ বিষাদময়।  আল্লাহ স্যারকে বেহেশত নসীব করুন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাইরোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

ঢাকাটাইমস/৪সেপ্টেম্বর/এসকেএস