‘উডপেকার’ এর সেই উদ্যমী দুই তরুণ

সৈয়দ ঋয়াদ
 | প্রকাশিত : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:১২

চাকরি করে দেখেছি, একটি নির্দিষ্ট কাজের মধ্যেই সারাক্ষণ লেগে থাকতে হয়। আসলে এতে করে একজন মানুষের সৃজনী সত্তা বা স্বকীয়তা বলতে কিছুই থাকে না, নেই কোনো চ্যালেঞ্জ। যেখানে নিজের মতামত প্রকাশের জায়গাও সীমিত। চাকরি জীবনে এই ছোট্ট উপলব্ধিটা হয়েছে। সে কারণেই নিজের মতো কিছু করতে মানসিকভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কথাগুলো বলছিলেন উডপেকারের প্রতিষ্ঠাতা মো. নাছির উদ্দিন ও শাহ আবিদুর রহমান।

কাঠের ছাঁচে নিত্যনতুন ডিজাইন করে সাড়া ফেলে দেওয়া বা কাঠের ফ্রেমে কারও ছবিকে নান্দনিক প্রকাশ যাদের হাতে অভিনবত্ব পেয়েছে এই দুজনই আজকের শীর্ষ উডেন ডিজাইন হাউস ‘উডপেকার’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই দুই তরুণ পড়াশোনা শেষ করেছেন দেশের শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে, সে কারণে এই দুই বন্ধুর পথচলাও একসঙ্গে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই নাছির উদ্দিনের সঙ্গে সখ্য হয় শাহ আবিদুর রহমানের। দুজনের ব্যাচের পার্থক্য ছিল, পার্থক্য ছিল বয়সেরও। তবে মনের দিক থেকে দুজনই ছিলেন একই রকম। পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ক্লাবেরই সদস্য ছিলেন আবিদ ও নাছির, যে কারণে তাদের বন্ধুত্বটাও স্থায়ী হলো।

শিল্পমনা এই দুই তরুণের যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত ইউনিভার্সিটির ছাত্র থাকা অবস্থায়। ছোট ছোট আউট সোর্সিং ডিজাইনের কাজ করেই। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা ও প্রিন্টিংয়ের বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পালন করেই সফলতা পেয়েছেন। নিজেদের স¦ভাবসুলভ সৃজনশীলতার কারণে পরে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ক্রেস্টের ডিজাইনসহ আরও অনেক কাজের দায়িত্ব এসেছে তাদের কাছে। এসব কাজ করে একটু-আধটু উপার্জনও করতেন ছাত্রাবস্থায়। এসব কাজ করতে করতেই প্রিন্টিংয়ের খুঁটিনাটি অনেক কিছুই শিখে গেছেন। মনে ধরেছে সেসব কাজ। তবে এই কাজ করে খুব একটা সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তারা।

কাজের বৈচিত্র্য খুঁজতে খুঁজতেই কাঠে খোদাই বা অ্যানগ্রেভিংয়ের নেশা পেয়ে বসে দুজনের। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেই উড অ্যানগ্রেভিংয়ের কথা ভাবলেও শুরু করতে সময় লেগেছে অনেকটা। ২০১৪ সালের শুরুতেই ‘উডপেকার’ নামে ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে শুরু করেন এই ব্যবসা। তবে পুরোদস্তুর ব্যবসা শুরু করার আগের গল্পটা ছিল ভিন্ন রকম। প্রথমে নিজেদের ব্যবহারের জন্য কিছু চাবির রিং, প্লেট ও ফ্রেম তৈরি করেন নাছির এবং আবিদুর। নিজেদের ডিজাইন করা এসব অ্যানগ্রেভিং করা চাবির রিং, ছবির ফ্রেম নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদের উপহারও দিচ্ছিলেন।

অ্যানগ্রেভিং করা কাঠের ফলকে তাদের করা বিভিন্ন ডিজাইন বিশেষ করে মানুষের ছবি দারুণ জনপ্রিয় হয়। এর আগে অনলাইনে কাজের অর্ডার পেয়ে বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করিয়ে দিতেন। তখনো উড অ্যানগ্রেভিংয়ে মানুষের ছবি করা শুরু করেননি। সেখানে কাঠের ফলকে খোদাই করে (উড অ্যানগ্রেভিং) বিভিন্ন রকম ডিজাইন, লোগো, চাবির রিংসহ আরো নানা রকম অ্যানগ্রেভিং প্রোডাক্ট তৈরি করতেন।

অ্যানগ্রেভিংয়ে মানুষের ছবি যুক্ত করে ডিজাইন করতে শুরু করেন। এ ধরনের ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুকে, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে) জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বিভিন্ন করপোরেট হাউস উডপেকার থেকে কাজ করাতে আগ্রহী হয়ে উঠে। একটা সময় শাহ আবিদুর রহমান ও নাছির উদ্দিন নিজেদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘উডপেকার’-এ মনোযোগী হন। আউট সোর্সিং করা উডপেকারকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন আর তাদের প্রতিষ্ঠান উডপেকার ফেসবুক পেইজটিতে যুক্ত আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখের মতো মানুষ। তাদের সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পছন্দ করছে উডপেকারের নান্দনিক সব কাজ।

প্রথমে শাহ আবিদুর রহমানের পরিবার থেকে চাকরি ছেড়ে এ ধরনের ব্যবসায়ের বিরোধিতাও করা হয়। তবে হাল ছেড়ে দেননি তিনি।

উডপেকারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নাছির উদ্দিন বলেন, পরিবার থেকে খুব একটা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইনি। তবে পরিবার সব সময় চেয়েছে যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, যেন ভালো বেতনের একটা চাকরি করি।’ অবশ্য এখন সবাই আমাদের ব্যবসার খোঁজখবর নেয়। এখন উডপেকারে ফুলটাইম কাজ করছে ১৫ জনের একটি দক্ষ টিম।

উডপেকারে পার্টটাইম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছে ইউনিভার্সিটি-কলেজে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী। এই বিষয়ে উডপেকারের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাহ আবিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এই একটা উইন্ডো ওপেন রেখেছি তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য যেন তারা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। নিজেদের পকেট মানিটা এখান থেকে আয় করতে পারে।’ উত্তরায় নিজেদের কারখানা-অফিস প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটাও ছয় বছর হয়েছে। প্রথম অবস্থায় কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় খুব একটা প্রোডাক্ট প্রমোশনও বাড়াতে চাননি। এরই মধ্যে একটি সেটাপে কাজ করলেও, ইচ্ছা আছে চলতি বছরের মধ্যে বড় একটা কর্মীবাহিনী তাদের হয়ে কাজ করবে।

‘উডপেকার’ উড অ্যানগ্রেভিং ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অনেকটা নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন নাছির ও আবিদুর। এই দুই তরুণের হাত ধরেই উড অ্যানগ্রেভিং আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর কর্পোরেট লেভেলেও উড অ্যানগ্রেভিংকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে উডপেকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান এসএস গ্রুপ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানও।

বাংলাদেশের অ্যানগ্রেভিংকে শুধু জনপ্রিয় করে তোলাই নয় বরং পুরো অ্যানগ্রেভিং মার্কেটটি নিজেদের করে নিতে চান এই দুই তরুণ। বেশ কিছু ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাজ করছে উডপেকার। পাশাপাশি ইউএস ইউকে, কানাডাসহ ইউরোপ-আমেরিকার বাজারেও বেশ কিছু অর্ডার প্লেস করেছে তারা। তবে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু অনিয়মের কথা জানান উডপেকারের এই দুই প্রতিষ্ঠাতা। তারা মনে করেন, যদি পণ্য রপ্তানিতে ঝামেলা পোহাতে না হতো, তাহলে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বড় বাজারেও নিজেদের পণ্য ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যেতো। যদি এসব দেশে এখন তাদের পণ্য যাচ্ছে।

নিজেদের প্রোডাক্টের ধরনের কথাও বলেন তারা। জানান, প্রথমে কাঠের অ্যানগ্রেভিং করা চাবির রিং, ছবি, ঈদ কার্ড তৈরি করলেও সেটা এখন আরও বিস্তৃত করেছেন তারা। উডপেকারের ফেসবুক পেজে সেসব কাচের নমুনা ছবিও ব্যবহার করেছেন। এছাড়া কাঠের যেকোনো কাস্টমাইজড প্রোডাক্টও তৈরি করে দিচ্ছেন তারা। এই বিষয়ে নাছির বলেন, আমরা নান্দনিক সেল্ফ, কর্নার, ডিজাইন মিরর, ছোট টেবিল, টিস্যু বক্স, গয়নার বক্স এসব করছি।

নাছির বলেন, এছাড়া কিচেনের কিছু নান্দনিক কাঠের পণ্য তৈরি করছি, যেমন কিচেন রেক, কিচেন টিস্যু হোল্ডার, কিচেন অর্গানাইজার, বিভিন্ন ধরনের কাঠের পরিবেশবান্ধব নান্দনিক চামচ। এর পাশাপাশি অনেক ধরনের কাস্টমাইজড গিফট আইটেম আমরা তৈরি করছি। এই সব পণ্য আপনারা আমাদের ফেসবুক পেইজসহ দেশের শীর্ষ ই-মার্কেটে অর্ডার করতে পারেন যেমন ইভ্যালি, দারাজ, আজকের ডিল, টেলিগ্রাম ও শপথ-এর মতো সাইটগুলোতে পাবেন। আর শিগগিরই আমরা আমাদের গ্রাহকদের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করছি। সেটার কাজও এগিয়ে চলছে।

উডপেকারের প্রতিষ্ঠাতা নাছির বলেন, প্রথম ব্যবসা নয়। এর আগে আমরা অনেক কাজ করেছি, সেসব এক্সপেরিমেন্ট এখানে অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করেছে। তরুণদের প্রতি চাকরি করা বা পরনির্ভরশীলতার মানসিকতার ঘোর কাটিয়ে নিজেদেরকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হবে।’ বরং সেটি ছোট হলেও নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। শুধু এ পরিকল্পনা না করে রিস্ক নিয়ে কাজে লেগে পড়ার কথাও বলেন নাছির উদ্দিন ও শাহ আবিদুর রহমান।

ঢাকাটাইমস/৪ সেপ্টেম্বর/এসআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

ঢাবির কেমিস্ট্রি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক কামরুল, সম্পাদক আফতাব আলী

বিডিবিএল-সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রথম প্রান্তিক ব্যবসায়িক সম্মেলন

তিন উৎসবে রঙিন এনআরবিসি ব্যাংক

নারীর অধিকার আদায়ে ইসলামী ব্যাংকের মুদারাবা মোহর সঞ্চয়ী হিসাব

রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা

ব্যাংক এশিয়া কিনে নিচ্ছে পাকিস্তানি আলফালাহ ব্যাংক

এনসিসি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তি

এক্সিম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন মইদুল ইসলাম

ডিএমডি হলেন অগ্রণী ব্যাংকের শামিম উদ্দিন আহমেদ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :