‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না’

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:১১ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:০৯

সুজয় সরকার

মাস তিনেক আগের কথা, হলের বড়ভাই ও বর্তমান সহকর্মী জানালেন ঢাকায় এসে আমাকে 'বাতিঘর' এ নিয়ে যাবেন। তারও প্রায় দুমাস আগে থেকেই তিনি আমাকে ঠেলে যাচ্ছেন বাতিঘরে নেওয়ার জন্য। এত বছর ঢাকায় থেকেও আমার নিজেরও কখনো যাওয়া হয়নি। ভাবলাম অন্তত একটা ছবি তোলার জন্য হলেও একবার যাওয়া উচিৎ। গিয়ে কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেলাম ক্যাম্পাসের আরেক বড়ভাই ও সহকর্মীকে। দুজনের কাছ থেকে ধরে-বেঁধে দুইটা বই উপহার নিলাম; দুটোই লালরঙা মলাট আর প্রচ্ছদ দেখে (যেহেতু ছবি তোলার উপলক্ষে গিয়েছি তাই বইয়ের নাম থেকে রং প্রাধান্য পাবে এ আর এমন কি!)

এর একটি 'শবনম', সৈয়দ মুজতবা আলীর 'শবনম'।

'শবনম' উপন্যাস, নাকি কাব্যোপন্যাস, নাকি চিরায়ত প্রেমের আখ্যান সে আলোচনা এখানে মুখ্য তো নয়ই, নেহাৎ দৈব। বইটি পড়া অবস্থায় এক ছোট ভাইয়ের সাথে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছিল, তার নাকি শেষ করে প্রচন্ড কান্না এসেছিল, 'বন্ধনহারা ধারা গঙ্গোত্রী'র মতো কান্না। আমার কান্না আসেনি, আনন্দও পায়নি, বৈষ্ণব পদাবলীর 'পূর্বরাগ' বা ইংরেজি সাহিত্যের 'romantic melancholy' বলতে যা বোঝায় তাও অনুভূত হয়নি। তবে হাইড্রলিক হর্ণের মতো প্রচন্ড কানে বেজেছে শবনমের এই হাল্কা উষ্মামিশ্রিত অনুনয়। লেখকের কাবুল উপত্যকায় অবস্থান, কান্দাহারের সিংহাসনের জবরদখল, কাবুলের অনিশ্চিত যাত্রা, শবনমের নিরুদ্দেশ যাত্রা আর লেখকের ভাবলেশহীন দৃশ্যান্তর; সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেন শবনমের এই অনুযোগ-অনুনয়। এ যেন গ্রিক ট্রাজেডি 'ঈডিপাস'-এর ডেলফিয়ান ওরাকল, ফলবেই।

কাল থেকে খুলছে স্কুল-কলেজ; সুদীর্ঘ দেড় বছর পর। আচ্ছা, এই দীর্ঘ বিরহে কেউ অভ্যস্ত হয়ে যায়নি তো! স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা কর্মকর্তা-কর্মচারী?

 

ঢাকায় থাকার সুবাদে বা অমোঘ কারণে প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই; বহুচর্চিত 'প্রাণের ক্যাম্পাস' এর তাড়নায় বা 'ছা-ছপ-শিঙাড়া'র আবেদনে সে প্রসঙ্গ আরেকদিন হবে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন কিছু মানুষের আচরণে যে 'ধুর-ধুর-ছেই-ছেই' ভাব প্রত্যক্ষ করেছি তাতে মনেই হতে পারে ছাত্রছাত্রীদের বিরহে এই ক্যাম্পাস অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বিপরীতে অনেক স্তূপাকার উদাহরণ আছে। আমার এক বন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক, তার সাথে দেখা হলেই এমনভাবে জ্ঞান দেওয়া শুরু করে যেন আমি একাই তার লেকচার থিয়েটার জুড়ে আড়াইশ ছাত্রছাত্রী। আহা! বিরহ যে তাকে আরও উদগ্রীব করেছে এ যেন তার রাজসাক্ষী।

আজই নিউজে দেখলাম গাজীপুরে স্কুল খুলবে এজন্য বন্যায় ডুবে যাওয়া স্কুল মাঠে চলছে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ। সেদিন দেখলাম, স্কুল খোলার সংবাদ পেয়েই একদল ছাত্রছাত্রী স্কুলে ভিড় করেছে। আমার কিছু সাবেক সহকর্মীকে দেখলাম তো তারা যেন বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; আহা! যেন কতকাল পরে পেটপুরে ভোজন। ফেসবুকে দেখলাম আমার প্রথম প্রণয় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ (রাইফেলস্ পাবলিক) এ বিয়েবাড়ির ধুম; যেন আজ গায়েহলুদ, কাল বিয়ে।

আহা রাইপাবলিক! কতগুলো বছর কেটে গেল লেকচার ডায়াসে দাঁড়াইনি। সামনে একগাদা বাচ্চাকাচ্চা, 'আপনার তালে নেচে যাই' এর মতো একটানা বকবক করা, কয়েক জোড়া গুণমুগ্ধ চোখ (খুব সামান্যই হয়তো হবে, আর বাকিরা তারাগোনা), কিচিরমিচির, কলকল-ছলছল, মাছের বাজার, সাইলেন্ট প্লিজ, শ্মশানের নীরবতা, আবার ফুঁসফাঁস-ফোঁসফাঁস... সাময়িক বিরক্তি আবার সেই ডায়াসের মোহ...

আহা! পাঁচ বছর হলো শিক্ষকতা ছেড়েছি। এতগুলো বছরেও যদি এই মোহাবিষ্টতার বিরহে অভ্যস্ত হতে পারতাম! খারাপ হতো না নিশ্চয়!

আচ্ছা, আমার যে সব সহকর্মী এখনো শিক্ষকতাতেই আছেন, থাকবেন বাকিটা জীবন, তারা এই দেড় বছর কেমন ছিলেন? তাদের তো এই বিরহে অভ্যস্ত হওয়ার লক্ষণ দেখিনি। কেমন যেন 'মন ভালো নেই' রোগে তারা ভুগেছেন এতদিন। মন ভালো হোক তাদের।

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ কাবুলের সিংহাসনের জবরদখলে দখল হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ডাকাত 'বাচ্চা'র দলের জোরজবরদস্তিতে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন অজস্র শান্তিপ্রিয় কাবুলিওয়ালা। এত বছর পর কাবুলে হয়তো সেই একই চিত্র, অন্তত বিমানের পাখা ধরে পালাতে চাওয়া মৃত্যুঞ্জয়ী কাবুলিওয়ালাদের ঘাসফড়িং হয়ে যাওয়া তাইই বলে। এবার কত-শত সৈয়দের শবনম বলি হবে তা কে লিখবে!

কাবুলের চিত্র দেখে যারা ঢেঁকুর তুলেছেন অবরে-সবরে, তাদের গুড়ে বালি দিয়ে কাল থেকে বেরিয়ে আসুক শতসহস্র স্কুলগামী বাচ্চাকাচ্চা, বেরিয়ে আসুক করোনা মহামারিকে জয় করে, বেরিয়ে আসুক আমাদের কন্যাশিশুরা অন্দর-বাইরে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য 'খাদ' মুভির প্রিয় গানের এক অন্তরা থাক আমাদের প্রার্থনায়-

"বলে, আয় রে ছুটে, আয় রে ত্বরা

হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জ্বরা।

 

ঢাকাটাইমস/১২সেপ্টেম্বর/এসকেএস