কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অভিযোগ

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:৩৬ | প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:৩৫

কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার ‘অপরাধে’ তালাকের শিকার হয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের গৃহবধূ আফরোজা আক্তার (২২)। বিয়ের মাত্র পৌনে দুই বছরের মাথায় সংসার ভাঙল তার। সালিশ, দেন-দরবার, হাতে-পায়ে ধরা কোনো কিছুতেই টেকাতে পারেননি সংসার। তবে অভিযুক্ত রুহুল আমিন (৩০) বলছেন, মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, একথা ঠিক নয়।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কামারহাটিয়া গ্রামের আবুল হাশেমের মেয়ে আফরোজা। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে পাশের নোয়াবাদ ইউনিয়নের সিন্দ্রিপ গ্রামের সাবেক মেম্বার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে রুহুল আমিনের সঙ্গে আফরোজার বিয়ে হয়। রুহুল আমিন পেশায় আনসার সদস্য। বর্তমানে তিনি জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় কর্মরত।

রুহুল আমিনের স্বপ্ন ছিল প্রথম সন্তান হবে ছেলে। কিন্তু স্ত্রীর কোলজুড়ে এসেছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। এ ‘অপরাধে’ স্ত্রী আফরোজার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। অবশেষে তাকে তালাক দেন স্বামী রুহুল আমিন। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ছোট শিশুটিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন এখন অসহায় আফরোজা।

বিষয়টি নিয়ে কয়েক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে সালিশ বৈঠক হলেও মন গলেনি স্বামী রুহুল আমিনের। তিনি কন্যা সন্তানের মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাক শুনতে চান না বলে সালিশে সাফ জানিয়ে দেন। সালিশে তাকে চরমভাবে ধিক্কার জানানো হলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এ ঘটনায় সালিশকারীরা হতভম্ব হয়ে যান। এলাকার লোকজন বিস্মিত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে এখন চলছে তোলপাড়।

২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রুহুল-আফরোজার বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল এবং প্রায় দুই লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয়। বিয়ের পর ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিছুদিন পরই গর্ভধারণ করেন আফরোজা।

আফরোজা অভিযোগ করে বলেন, ‘সন্তান যখন পেটে আসে তখন অসুস্থ হয়ে যাই। আট মাসের সময় আমি বাবার বাড়িতে চলে আসি। স্বামী আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলেন। আলট্রাসনোগ্রাম করাতে গিয়ে জানা গেল, আমার মেয়ে সন্তান হবে। এ খবর শুনেই বদলে যায় রুহুল। তিনি এরপর থেকে আমার সঙ্গে মোবাইল ফোনে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। আমাকে এক নজর দেখতে আসেননি। আমাকে জানিয়ে দেন, মেয়ে হলে তার মুখও দেখতে আসবে না।’ এ পরিস্থিতিতে গত ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেয় আফরোজার মেয়ে সন্তান। নাম রাখা হয় ‘নুসরাত’।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফরোজা বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, নুসরাতের মুখ দেখে ওর বাবার মন পাল্টে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। নুসরাত হওয়ার একমাস পর স্বামী রুহুল মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে আর ঘর করবেন না বলে মৌখিকভাবে তালাক দিয়ে দেন। নুসরাত শব্দের অর্থ ‘প্রতিরক্ষা’ হলেও সে আমাকে প্রতিরক্ষা দিতে পারেনি।’

আফরোজার বড় ভাই আব্দুল হালিম বলেন, ‘বিয়েতে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল ও প্রায় দুই লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয়। মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়ায় রুহুলের মন খারাপ হলে আমরা প্রস্তাব দেই, শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনে আরও দুই লাখ টাকা দেবো। তারপরও আমার বোনের সংসার টিকাতে পারিনি।’

আফরোজার মেয়ে নুসরাতের বয়স এখন আট মাস। শিশুটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিষয়টি মীমাংসার উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী। গত ২৮ আগস্ট জয়কা ইউনিয়ন পরিষদে এ ব্যাপারে সালিশের আয়োজন করা হয়। এতে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন, পাশের ইউনিয়ন গুনধরের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির নূরু শিকদারসহ অন্তত তিনটি ইউনিয়নের গণ্যমান্য লোকজন উপস্থিত ছিলেন। ওই সালিশেও কোনো কাজ হয়নি। সালিশ শেষে লিখিতভাবে তালাক পান আফরোজা।

সালিশে উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতা এমদাদুল হক বলেন, ‘রুহুল আমিন কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে ক্ষিপ্ত হন। তিনি ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। আর এ কারণে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেন বলে সালিশে প্রমাণ হয়।’ তিনি বলেন, ‘সালিশে উপস্থিত প্রায় সবাই রুহুলকে বুঝিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে লিখিত তালাকের ব্যবস্থা করা হয়।’

জয়কা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মীর হুসেন বলেন, ‘শালিশে রুহুল স্পষ্ট ভাষায় বলেন মেয়ে সন্তান আমি চাই না, আমি তাকে নিয়ে কিছুতেই সংসার করতে ইচ্ছুক না। তার কথায় শালিশে উপস্থিত জনতা হতভম্ব হয়ে যায়। কিছুতেই তাকে বুঝানো যায়নি। আমরা সংসারটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। রুহুলের একগুয়েমির জন্য সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।’

এ বিষয়ে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘সালিশে আফরোজার অন্য কোনো দোষত্রুটি দেখাতে পারেনি রহুল। কেবল মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে তালাকের ঘটনা ঘটেনি। এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে।’

গুনধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির নূরু শিকদার বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি, যেহেতু তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে। সংসারটি যেন টিকে থাকে। কিন্তু রুহুলের একগুঁয়েমির কারণে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।’

এ বিষয়ে রুহুল আমিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি একথা ঠিক না। সে (আফরোজা) আমার কথা শুনতো না। মেয়ে হওয়ার পর সে আমার সঙ্গে আরও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করে। আমি ফোন কল দিলে প্রায় সময় তার নাম্বার ব্যস্ত থাকে। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলে আমার মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। আরও নানা কারণে তাকে তালাক দিয়েছি আমি।’

(ঢাকাটাইমস/১৩সেপ্টেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :