কনস্টেবল বাল্যবন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ালেন এসপি

প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:২৭ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

বন্ধু কারা? এই প্রশ্নে প্রতিটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দেয়। বন্ধুত্বের কথা জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ মানুষই বাল্যকালের বন্ধুত্বের কথাই উল্লেখ করে থাকেন। কারণ সেই সময়ের বন্ধুত্বটা হয় নিছক বন্ধুত্বের জন্য—কোনো স্বার্থের মোহে নয়। তবে, খেলার সাথি থেকে শুরু করে বিপদে-আপদে, সুখে দুঃখে, মাঠে ময়দানে, স্কুল কলেজের বারান্দায় সময় কাটিয়ে জীবনের নানান বাঁকে পরিচয় হওয়া মানুষের সঙ্গে হয় বন্ধুত্ব। তবুও সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাল্যকালের খেলার সাথিদেরই। চোখের অন্তরাল হলেও মনের ফ্রেমে, কল্পনায় উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে কাটানো স্মৃতিময় দিনগুলো।

সময়ের পরিক্রমায় পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থানেও যারা কখনো বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বদলান না তারাই আসল বন্ধু। এমনই এক বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত রাখলেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির সাইবার ক্রাইম শাখায় কর্মরত বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) রেজাউল মাসুদ।

এই কর্মকর্তা তার স্কুলজীবনের বন্ধু কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিকের বিপদে কেবল আশ্বাস দিয়ে নয়, বাস্তবিকভাবেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। যে কারণে ওই বন্ধুর পরিবারেও প্রশান্তি নেমে এসেছে।

এ নিয়ে সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে একটি পোস্ট দেন পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকাটাইমসের পাঠকদের জন্য পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদের দেয়া হলো-

‘বিসিএস এর রেজাল্ট যেদিন বের হয় সেদিন কীভাবে জানি সে খবর পেয়ে যায়। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে খুশিতে তার উল্লাস-উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। মনে হচ্ছিল যেন সেই চাকরি পেয়েছে। বলতেছিল তুমি পুলিশে এএসপি হয়েছো, একসময় এসপি হবে, ডিআইজি হবে। কী যে ভালো লাগছে আমার তোমাকে বুঝাতে পারব না, মনে হচ্ছে যেন আমিই এএসপি হয়েছি। সে বলতেছিল আমাদের এলাকায় শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার অনেক রয়েছে, কিন্তু বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা একেবারেই নেই, তুমি আমাদের এই অভাবটা পূরণ করলে। কথাগুলো সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল।

সিদ্দিক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিউমার্কেট থানার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমরা ছেলেবেলার বন্ধু, প্রাইমারি আর হাইস্কুল একইসাথে পড়েছি। সুদর্শন সুঠাম চেহারার সিদ্দিক এসএসসি পাশ করার পর পুলিশে যোগ দেয়। একজন টগবগে যুবক দ্রুত চাকরি পেয়ে এলাকায় পুলিশ সিদ্দিক হিসেবে পরিচিতি পায়। সবাই তাকে চিনে, মানুষের প্রয়োজনে সাধ্যমত কমবেশি সে পাশে দাঁড়ায়। ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা ভার্সিটি পড়াকালীন সময়েও আমার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে সে। পনের বছর পুলিশি চাকরিকালীন সময়ে তার সাথে অনেক দেখা হয়েছে কথা হয়েছে, তার এলাকার সমস্যায় আমাকে ইনভলভ করেছে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই ছেলেবেলার মতনই। আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব যারা সাব-ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট থেকে ইন্সপেক্টর হয়েছে, আবার অনেক বন্ধু বিসিএসের জুনিয়র তাদের সাথে সাক্ষাৎ কিংবা কথা হলে আমি সহজ করে দিলেও তাদের ভিতর একটা অস্বস্তি ভাববাচ্য কাজ করে তারা আমায় আপনি বলবে, না স্যার বলবে না তুই বলবে দ্বিধায় থাকে!

কিন্তু কনস্টেবল বন্ধুটির মাঝে বিন্দু পরিমাণ ভাবনা আসতে দিতাম না, যাতে সে কখনোই মনে না করে তার সামনে আমি একজন বড় কর্মকর্তা, সে যেন সবসময় ধারণা রাখে আমি তার ছেলেবেলারই বন্ধু। অতি সম্প্রতি সে ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে সিলেট বিভাগে বদলির আদেশ পান। তার পরিবার সন্তান সন্ততি নিয়ে ময়মনসিংহ বসবাস করেন। জামালপুর গ্রামের বাড়ি মা-বাবা ভাই-বোনসহ অনেকের প্রয়োজনে মুহূর্তেই পাশে দাঁড়ান। সিলেট বিভাগে বদলির খবরে দারুণ অসহায় বোধ করে এবং ভেঙে পড়ে সে। চারদিকে জোর চেষ্টা-তদবির দৌড়িয়েও বদলি বাতিলে ব্যর্থ হয় সে। তার সমস্যার কথাটা অবশেষে আমায় জানায়। পুলিশের জুনিয়র সদস্যদের জেলার ভেতরে বদলির জন্য সহজে চেষ্টা করা যায় কিংবা বিভাগের মধ্যেও ডিআইজি স্যারকে বলা যায়। কিন্তু এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে বদলি আইজিপি স্যারের অফিস তথা পুলিশ সদর দপ্তর করে থাকে, সেজন্য এ কাজটা সবসময়ই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। নিয়তি আর ভাগ্য বলে মেনে নেয় অনেকেই। সিদ্দিক অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়।

আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে যোগাযোগ করি। সাত দিনের ভেতরেই সিদ্দিকের কাজটা হয়ে যায়। আমি আগেও এরকম কাজে চেষ্টা করেছি অনেককে বদলি করিয়েছি, কিন্তু এটা এত দ্রুত সাত দিনের ভেতরে হয়ে যাওয়ায় আমি তাজ্জব বনে আশ্চর্য হই আবার লজ্জাও বোধ করি, ফোন না করে শুধুমাত্র টেক্সটে থ্যাংকস জানাই।

পুলিশ সদর দপ্তরের কনসার্নড ডেস্ক অফিসার এআইজি মাহবুব ভাই চব্বিশ বিসিএস-এ আমার ব্যাচমেট। সশরীরে তার সাথে সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতায় বলি, ম্যাজিকের মতো কাজ টা কীভাবে এত দ্রুত করে দিলেন? মাহবুব ভাইয়ের উত্তরটা ছিল মাত্র দুলাইনের, একজন কনস্টেবলের আপনত্ব বোধে যেভাবে হাইলাইটস করে আপনি বলেছেন, সে আপনার প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের বন্ধু, একই এলাকার আপনারা। বদলিতে তার পরিবার পরিজন নিয়ে বিপদে পড়ছে, ভাই আপনি একটু দেখবেন প্লিজ! আমার কাছে আপনার আকুতিটা এতো ভালো লাগছে যে আপনি একজন সামান্য কনস্টেবলকে সম্মান দিয়ে নিজের ভাই, বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন! অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে তাই আপনার বন্ধুর কাজটাই আমার কাছে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।’

ঢাকাটাইমস/১৪সেপ্টেম্বর/এআর/ইএস