করোনাকালীন জীবনযাপন

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:১২

ফাহমিন আফরোজ

ইমি বাসায় এসে দেখে তার আম্মু-আব্বু বাসায় ফিরেছেন। ওনারা কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন কমপ্লিট করে এলেন। প্রথম ডোজ দেওয়ার দু’মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে কাল। সামনে রোজা। তাই ফার্স্ট সুযোগেই ওনারা টিকা নিয়ে শেষ করলেন। রোজার মধ্যে যদি কোনো অসুবিধা লাগে তাই। ইমি বা তার ছোট ভাই কারোরই টিকা নিতে হবে না। কারণ সরকারের অনুমোদন নেই। বয়স ৪০ না হলে কেউই টিকা দিতে পারবে না। ইমি একটু অফিসে গিয়েছিল। সেখানে অনেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন নিয়েছে। কারোর প্রথম আবার কারোর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া হয়েছে।

মিসেস গুলশানারা একবার ভেবেছে বাচ্চারা যেহেতু দেবে না তাহলে তো তাদের করোনাভাইরাস ছড়াবে না, তাই তিনিও দেবেন না। যদি দিতেই হয় তবে অনেক পরে। কিন্তু ইমরোল আবিদ সাহেব ওনার স্ত্রীকে বুঝালেন। বললেন দেখো ইন্ডিয়া থেকে এই সিরাম টিকা এসেছে। যত সংখ্যক লোক বাংলাদেশে আছে তত সংখ্যক টিকা আসেনি। তাছাড়া অনেকে টিকা নিলে দেশের আবহাওয়ারও পরিবর্তন আসবে। ফলে এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সকলের সমহারে বাড়বে। আর সবার তো সুযোগ আসেনি। তাছাড়া প্রেসার, ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা এসব বহু রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও এই টিকা সহায়তা করে। বিনামূল্যে টিকা নিয়ে এতসব সুযোগ-সুবিধা নেওয়া পরবর্তীতে যদি সম্ভব না হয়। তাই চল লক্ষ্মীটি আমরা দুজনেই টিকা দিয়ে আসি। কারণ ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে সবাই তো এই করোনাভাইরাসটির ভ্যাক্সিন নিতে পারবে। মি. ইমরোল আবিদ তার স্ত্রীকে বললেন তোমাকে জিজ্ঞেস করেই তো রেজিস্ট্রেশন করলাম। একবার রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে সে হসপিটাল কেন্দ্রেই শুনেছি টিকা নিতে হবে। গুলশানারা বলেন, আমি পরে দেই। কিছুদিন পিছিয়েও নাকি দেওয়া যায়। অসুবিধার কথা বলে আমি না হয় পরেই দেই। তাছাড়া তুমি দিলে যদি কোনোরকম অসুবিধা হয়। শুনেছি জ্বর, গা ব্যথা, টিকার স্থান ফুলে যেতে পারে তখন তোমার সেবা-যত্নটা কে করবে। ইমির অফিস আছে রিফাতও বয়সে ছোট। পড়ালেখা শেষ হয়নি। ওদের কি হবে যদি দুজনের একসাথেই টিকার পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে যায়।

ইমরোল সাহেব একটু ভাবনায় পড়লেন। কিন্তু কিছুক্ষণ ভেবে আবারও স্ত্রীকে বোঝালেন, দেখো আমাদের কত আত্মীয় স্বজন, কত কলিগরা ভ্যাক্সিন নিয়েছে। কই তাদের তো কিছুই হয়নি, দিব্যি ব্যাংকে চলে এসেছে। তেমন কোনো প্রবলেম কারোরই হয়নি। ওই দুদিন, তিনদিন কি চারদিন পরে সবাই ঠিক হয়ে যায়, তা তো অন্য কোনো ইনজেকশন নিলেও হতে পারে। শুনলাম টিকা নিলেও কোনো সমস্যা হয় না। সাধারণ টিকার মতোই লাগে। এখনই টিকা না নিয়ে ডোজ দুটো ক্লিয়ার না করলে রোজার মধ্যেই দিতে হবে। তখন কি করবে। অবশ্যই রোজা রেখেও দেওয়া যায় কিন্তু দরকার কি। চলো আমরা আগেই নির্দিষ্ট তারিখ মতো টিকা দিয়ে আসি। ইমি এমনকি রিফাত ছোট ছেলে সেও তাদের আম্মুকে বোঝায়। বলে, যাও আম্মু তুমি আব্বুর সাথে ভ্যাক্সিন নিয়ে এসো। আরে আমরা দু ভাই-বোনও সুযোগ পেলে তোমাদের সাথে গিয়ে দিয়ে আসতাম। গভর্নমেন্ট থেকে যে কেন ২৩ বছর থেকে টিকার পারমিশন দিল না। তাহলে ইমি আপুর সাথে আমিও দিয়ে আসতাম। ইমি রিফাতের কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে দেখলে আম্মু আমাদের রিফাতের কত সাহস আর বুদ্ধি। এভাবে সকলের চেষ্টায় আম্মু ও তাদের আব্বুর সাথে টিকা দিতে গেল। যদিও টিকা দেওয়া বা না দেওয়ার স্বাধীনতা সব মানুষেরই আছে।

ইমি আজ বাসায় এসে যখন দেখল বাবা-মা দুজনের টিকার দুটো ডোজই কমপ্লিট হয়ে গেছে তার আনন্দ আর ধরে না। ভাবে তাদের বাসা আজ সত্যিই করোনাভাইরাস মুক্ত হলো। এভাবে গোটা দেশটাই দেখা যাবে করোনামুক্ত হয়ে গেছে। সে এনজিও অফিসে হেড কো-অর্ডিনেটর হিসেবে চাকরি করে। তার ছোট ভাইটা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। এখন ক্লাস ভালোভাবে শুরু হলে পাস করলে একদিন ডাক্তার হয়ে যাবে। তাদের পরিবারের ইচ্ছা রিফাত বিলেত ফেরত ডাক্তার হবে বা ইউকে/ইউএসএ থেকে এফসিপিএস করবে। ইমি বছর দুই হলো এনজিওতে জয়েন করেছে। বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কর্মস্থল। করোনার কারণে উন্নয়ন অনেক থেমে রয়েছে। বিদেশেও তাদের অফিসের অনেক নাম আছে। রপ্তানিমুখী কর্মক্ষেত্র একটা ওই অফিস। সে সেখানকার একজন উচ্চপদস্থ চাকুরে। এত অল্প বয়সে এমন ভালো চাকরি পেয়েছে শুধু ভাগ্য জোরে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্কলার সে। শীর্ষে তার স্থান ছিল রেজাল্ট দিয়ে। গোল্ড মেডেল পেয়েছে। তারও আরও পড়াশোনার ইচ্ছে আছে। কিন্তু চাকরিটা তাকে বেশি টেনেছে। তাই চাকরিতে জয়েন করেছিল।

ইমরোল আর গুলশানারা ইমির বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে দেশেই আছে। তবে ইমিগ্রান্ট তাই বিয়ের পর বিদেশে চলে যাবে। ওনারা তেমন রাজি ছিলেন না কিন্তু মেয়ে পছন্দ করেছে। চাকরি ক্ষেত্রে পরিচয়। তাদের অফিসে পরিদর্শক হিসেবে বিদেশি লোকের সাথে এসেছিল। তারপর দুজনের ভালো লেগে গেল। রিশু ইমিকে বলেছে বিয়ের পর বিদেশে তাকে ডক্টরেট করাবে। এই তো রোজার ঈদের পর তাদের বিয়ে হওয়ার কথা। কোরবানির ঈদের পর চলে যাবে আমেরিকা।

সে যা হোক ঈদের সময়ের মধ্যে যদি বাংলাদেশের সুদিন আসে তবে ইমির বিয়েটা হয়ে যাকে। রিফাতও মেডিকেল কলেজের পড়া শেষ করবে। ইমি, রিফাত, গুলশানারা, ইমরোল আবিদ সকলেই শবেমেরাজ এবং শবেবরাতের রোজা রেখেছে। নামাজও পড়েছে রাতভর। ফল, মিষ্টি, জুস, কাবাব, কিমা, নানরুটি, পনির আর খেজুর, খিচুড়ি, ডিমের কোরমা, আলু মুরগির তরকারি ছিল ইফতারি। রোজার মাসটায় রোজা, কোরআন শরীফ আর নামাজ পড়বে। শেষে আনন্দে সবাই ঈদ পালন করবে। রোজা উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণে চপ, বেগুনি, বড়া, কাবাব, সমুচা, পুরি তৈরি করে ফ্রোজেন করে রাখা হচ্ছে। আবার ঈদে পোলাও, রোস্ট, রেজালা, গরু, খাসি ভুনা, বড় মাছের কোরমা, নানা মিষ্টি আয়োজনের লিস্ট ওরা করে রাখছে। ওরা রোজা ও ঈদের অগ্রিম খোস আমদেদ জানায় সকলকে।

কয়েক মাস পরের কথা। বাংলাদেশে এখন ২৬ বছর থেকে প্রতিটি নারী-পুরুষ, ছেলে- মেয়েরা টিকা নিতে পারছে। আর স্বাস্থ্য বিভাগের তো ১৮ বছর হলেই টিকা নিয়ে নিচ্ছে। হয়তো কিছুকাল পর ১৮ বছরের প্রত্যেকে বা তার কম বয়সের মানুষেরা এই কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার পারমিশন পাবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আর আপামর মানুষের সহায়তায় এ দেশের ঘরে ঘরে এই টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর পরে দেশে ক্রমবর্ধমান হারে উন্নয়নের গতি বেড়ে চলেছে।

এখন ইমিদের বাসার সকলেই ভাইরাসের টিকা নিয়ে নিয়েছে। ইমি আর রিশুর ইচ্ছেতে স্বল্প আয়োজনে তাদের বিয়েও দুই পরিবার মিলে দিয়ে দিচ্ছে। আগামী মাসেই বিয়ে। তবে সব দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হলেই ইমি ওর স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যাবে। রিফাত তার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কজন নিয়ে বিয়ের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। অনলাইনে পড়ার পাশাপাশি তাই নিয়ে সে ভীষণই ব্যস্ত। আব্বু-আম্মু আর ইমি আপুর পছন্দ অনুযায়ী তো সমস্ত বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।

 লেখক: কথাসাহিত্যিক