‘ফেক’ লাইক-সাবস্ক্রাইবার বিক্রি করছে দারাজ!

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৫২ | প্রকাশিত : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:৪০

১৭৬ টাকায় ১০০০ ফেসবুক পেজ লাইক। কিংবা ২০৯ টাকায় ১০০ ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন। এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ই-কমার্স প্লাটফর্ম দারাজ ফেসবুক লাইক, কমেন্টস, শেয়ার এবং ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার, ভিউ, কমেন্টস এবং লাইক বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরও অভিযোগ উঠেছে এর বেশির ভাগই ‘ফেক’। এসব ডিজিটাল সেবা নিয়ে অনেক গ্রাহক পড়েছেন বিপাকে। পয়সা দিয়ে কিনেও মিলছে না কাঙিক্ষত সেবা। তাদের অভিযোগ নির্ধারিত সময়ে অর্থ পরিশোধ করেও সেবা পাচ্ছেন না তারা।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ডিজিটাল সেবা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ নয়। এমনকি এই সেবা কিনলে হুমকির মুখে পড়তে পারেন সেবাগ্রহীতা। আর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, কেউ এ ধরনের সেবা নিয়ে প্রতারিত হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে।

দারাজের প্লাটফর্ম ঘুরে দেখা যায়, সেখান থেকে লাইক, সাবস্ক্রাইবার কিনে অনেকে প্রতারিত হয়েছেন। তারা সেখানে তাদের অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন আর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

দারাজের সেলার গ্লাম টাচ বিডি (GlamTouchBD) থেকে গত ২২ জুলাই ১৭৬ টাকায় ১০০০ ফেসবুক পেজ লাইক কিনেছিলেন গালিব নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তিনি তার পেজে লাইক পাননি। পরে ৩০ জুলাই তিনি দারাজের সেলারের পোস্টের রিভিউতে লেখেন, ‘বাটপার সেলার ডেলিভার্ড দেখিয়ে বসে আছে, কোনো সার্ভিস দেয় নাই। আমি আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো পরবর্তী কার্যদিবস থেকে।’

একই সেলারের পোস্টের রিভিউতে সাজ্জাদ নামের আরেক ক্রেতা অভিযোগ করেন, ‘ঈদের পর অর্ডার দিছিলাম। ওরা কোনো রেসপন্স দেয় নাই। অনেক দিন হয়ে গিয়েছিল কোনো লাইক পাই নাই। দেন দারাজ কাস্টমার সার্ভিসে আমি যোগাযোগ করি, তারপর আমি লাইক পাই।’

২৩৫ টাকা দিয়ে দারাজের সেলার জায়ান’স (Zayyan's) ফেসবুকের জন্য ১০০০ প্রোফাইল এবং ফলোয়ার কিনেছিলেন এমডি. ই. নামের ক্রেতা। তার অভিযোগ- ফেক আইডি, বেনামী আইডি থেকে এসব লাইক ও ফলোয়ার তাকে দেয়া হয়েছে। পণ্যের রিভিউতে তিনি লিখেছেন, ‘ক্ষ্যাত আর বাজে সব ফেক আইডি দিয়ে ফলো করবে। (উদাহরণ-একা একা জীবন আমার, রংবাজ মেয়ে মাহিয়া, রিলেশন মানে কস্ট, Ami Boro Eka, সমাজের কান্সার পরকিয়া, পপি থাই এন্ড এসএস)। এসব থেকে শুরু করে গালিগালাজ দেওয়া শব্দের আইডি থেকে ফলো দিবে। সিম্পলি, কারো আইডি ইমপ্রেশন নষ্ট করে দিতে চাইলে ‘হাইলি রিকোমেন্ডেড’। আমি সব ফলোয়ার ব্লক করে দিয়েছি।’

এ তো গেল ফেসবুক লাইক, ফলোয়ার কিনে প্রতারণার অভিযোগ। অন্যদিকে দারাজ থেকে ইউটিউবের জন্য সাবস্ক্রাইবার কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে একজন সুজা। তিনি অল ডিজিটাল সেবা (ALL Digital Sheba) থেকে ২০৯ টাকার বিনিময়ে ১০০ সাবস্ক্রাইবার কিনে প্রতারিত হয়েছেন। সেলারের পোস্টের রিভিউতে তিনি লিখেছেন, ‘ভাই, এনার কাছ থেকে কেউ অর্ডার করবেন না।... একটা বাটপার। ওরে যদি কাছে পাইতাম... আমারে চার-পাঁচ দিন ঘুরিয়ে আজ আমাকে বলে যে ফাইভ স্টার রিভিউ করতে।... তোরে আল্লাহ দেখবে। কেউ ভুলেও অর্ডার করবেন না ভাই... ।’

ওই একই সেলার থেকে ১ হাজার ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার কিনে অভিযোগ জানিয়েছেন মনির নামের এক ক্রেতা। তিনি সেলারের পোস্টের রিভিউতে এ বছরের ২৯ জুলাই অভিযোগ করেন, ‘৭ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল, ‘চেক করছি’ বলে এখনও কোন রেসপন্স নাই। এত বছরে দারাজে প্রোডাক্ট কিনছি এই প্রথম ফ্রডের হাতে পড়েছি। এরা কম দামের প্রোডাক্ট ডেলিভারী দেয়। বেশি টাকা হাতানোর জন্য। বেশি টাকার অর্ডার পড়লে সেটির ডেলিভারী দেয় না। সবাই সাবধান!’

ইউটিউব চ্যানেল মনিটাইজের শর্ত পূরণ করতে ব্রাদার্স জোন (Brothers Zone 159212282) থেকে ২১০ টাকায় ইউটিউব ভিউজ কিনেছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা। তার কেনা পণ্যের রিভিউতে লিখেছেন, ‘১ সপ্তাহ হতে না হতে ভিউ কমতে থাকে, তাদের জানালে আবার ১০০০ ভিউ দেয়, সেটাও কমতে থাকে। বারবার নালিস করতে ভালো লাগে না। এবং অনেক পরে এসএমএস রিপলে দেয়।’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ডিজিটাল সেবার আওতায় দারাজ ফেসবুক লাইক, ফলো, কমেন্টস, শেয়ার, ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার, লাইক, শেয়ার ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া দারাজ ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কোর্সও বিক্রি করছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ডিজিটাল সেবা ও কোর্স সার্টিফায়েট নয়। এগুলো ব্যবহারে উপকৃত তো হওয়াই যায় না বরং ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে।

পেওনিয়ার বাংলাদেশের সাবেক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট হেড এবং বিজকোপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও নাহিদ হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অর্থের বিনিময়ে ফেসবুক লাইক কিংবা ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন কেনা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য না। আইনগত বিষয়টা আমি বলতে পারব না। তবে আমার মতে পেইড লাইক এবং পেইড সাবস্ক্রিপশন দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনে না। বরং যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সেবা নেয় তাদের পেজ, চ্যানেল হুমকিতে পড়তে পারে।’

নাহিদ হাসান আরো বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে ফেসবুক লাইক, ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা আনইথিক্যাল পদ্ধতিতে এই কাজটি করে থাকে। এই কাজগুলো সাধারণত দুভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত, তারা হাজার হাজার ফেসবুক পেজ কিংবা ইউটিউব চ্যানেল খুলে রাখে। দ্বিতীয়ত কাজটা করা হয় রোবট দিয়ে। সমস্যাটা হয় তখনই যখন হঠাৎ করে একটি ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলের লাইক কিংবা সাবস্ক্রিপশন রাতারাতি বেড়ে যায়, বিষয়টা ধরে ফেলে ফেসবুক কিংবা ইউটিউব। তখন উভয় মাধ্যমের মনিটাইজেশন সেবা বন্ধ বা সীমিত করে দেয়া হয়। এমনকি অর্থের বিনিময়ে পাওয়া লাইক ও সাবস্ক্রিশপনের ফলে পেজ ও চ্যানেলটি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।’ তিনি এ জন্য এই ধরনের সেবা না নেয়ার পরামর্শ দেন।

একই কথা জানালেন ভার্চুয়াল ল্যাবের সিইও রিয়াজ। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সুফল পেতে হলে কাজটি অর্গানিকভাবে করা উচিত। অর্থের বিনিময়ে লাইক কিংবা সাবস্ক্রিপশন বাড়ানো যেমন নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি সংশ্লিষ্ট পেজ ও চ্যানেল ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কেননা, ফেসবুক এবং ইউটিউব ফেক লাইক ও ফেক সাবস্ক্রিপশন তাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির মাধ্যমে ধরে ফলে।’

অর্থের বিনিময়ে ফেসবুক লাইক কিংবা ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন কেনা-বেচার বিষয়টি নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অবশ্য কিছু বলা নেই। তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কেউ এই ধরনের সেবা নিয়ে প্রতারিত হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিকার পেতে পারেন। এই ধরনের সেবা নিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন তথ্য আমাদের কাছে এলে আমরা বিষয়টি দেখব।’

এ বিষয়ে দারাজের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা লিখিত প্রশ্ন চায়। দারাজের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল অনলাইনে ফেসবুক লাইক, কমেন্টস, ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন বিক্রি কতটা বৈধ?

উত্তরে দারাজ জানায়, ডিজিটাল ক্যাটাগরির সেলারদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, সেলাররা এমন কোনো পণ্য বিক্রি করবে না যা দেশীয় আইনের পরিপন্থী। ফেসবুক লাইক, কমেন্টস ও ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন কেনাবেচার সুযোগ ফেসবুক এবং ইউটিউবই করে দিচ্ছে। লাইক, কমেন্টস ও ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন কেনাবেচার এই পদ্ধতিকে ‘বুস্টিং’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকার বিনিময়ে ফেসবুক লাইক, ইউটিউব সাবস্ক্রিপশন কেনাবেচা বুস্টিংয়ের আওতায় পড়ে না। বুস্টিং বলতে সাধারণত পোস্ট বুস্ট করা বোঝায়।

দারাজের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এসব কেনাকাটায় কোনো ক্রেতা প্রতারিত হলে দারাজ কি এর দায় নেবে? উত্তরে দারাজ জানায়, সেই ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে রিটার্ন অ্যান্ড রিফান্ড পলিসি অনুযায়ী দারাজ ক্রেতাকে তার মূল্য ফেরত পেতে সাহায্য করে। কিন্তু কেউ এ ধরনের কেনাকাটায় প্রতারিত হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে বিচার চাইতে পারবে বলে জানিয়েছেন তথ্য-প্রযুক্তিবিদরা। এ ব্যাপারে দারাজ জানায়, তার আগে গ্রাহকদের উচিত সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা।

(ঢাকাটাইমস/১৯সেপ্টেম্বর/এজেড/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :