থামছে না মনোস্পুল ও পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ার কারসাজি!

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১৫

রহমান আজিজ, ঢাকাটাইমস

পুঁজিবাজারে একগুচ্ছ অনিয়মে ২০০৯ সালে বিভিন্ন খাতের ৬৬টি কোম্পানিকে মার্কেট থেকে সরিয়ে (ওভার দ্য কাউন্টার) ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এবং পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। তবে মুনাফায় ফেরার পাশাপাশি সুশাসনে উন্নতি করায় গত ১৩ জুন ওটিসি মার্কেট থেকে এই দুটি কোম্পানিসহ চারটি কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনা হয়। এসেই কারসাজি শুরু করেছে এই দুই কোম্পানি।

কেন শেয়ারদর বেড়েছে, কারা এই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত তা খতিয়ে দেখতে গত ১০ আগস্ট একটি চার সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে ফের হু হু করে বাড়ছে পেপার প্রসেসিং ও মনোস্পুলের শেয়ারদর। গত তিন মাসে মনোস্পুলের শেয়ারদর ২৮১ শতাংশ ও পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ারদর বেড়েছে ১০৬৮ শতাংশ। 

নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসইসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করা, বিএসইসিকে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, লভ্যাংশ প্রদান না করা ও সিকিউরিটিজ আইন পরিপালন না করাসহ একগুচ্ছ অনিয়মের কারণে ২০০৯ সালে মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এবং পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডসহ ৬৬টি কোম্পানিকে ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯৮৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৯০ সালে তালিকাভুক্ত হয় পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডে। এ কোম্পানি দুটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন।

উভয় প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সিএফও হিসেবে নাইমুল ইসলাম, হেড অফ ইন্ট্রানাল অডিটর মো. সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠান দুটির ফ্যাক্টরি শ্রীরামপুর, ধামরাই দেখানো হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা দেখানো হয়েছে প্লট নং- ৩১৪/এ, রোড নং- ১৮, ব্লক-ই, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।

এদিকে করপোরেট গভর্ন্যান্স কোর্ড (৩ জুন ২০১৮) এর ৩ (১) (সি) ধারায় বলা আছে, কোনো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানি সচিব বা প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা একইসময় অন্য কোনো কোম্পানি, প্রতিষ্ঠানে একই পদে বা অন্য কোনো পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, এ দুটি প্রতিষ্ঠান করপোরেট গভর্ন্যান্স কোর্ডের কমপ্ল্যান্স না মানলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

করপোরেট গভর্ন্যান্স কোর্ড পরিপালন না করলে আইনে কী ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলে বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে জানান, কেউ এটি পরিপালনে ব্যর্থ হলে প্রথমত বিএসইসি সেই কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয়। উত্তর সন্তোষজনক না এলে জরিমানা করা হয়। এছাড়া তাদেরকে যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

পেপার প্রসেসিং ১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৩০ বছর কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। তবে তারা মূল মার্কেটে আসার জন্য ২০২০ সালে ২২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পেপার প্রসেসিং মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ১৫৭ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুই কোটি ৫৯ কোটি লাখ ২৩ হাজার ৪৯৫ টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছয় কোটি ১৩ লাখ ১৬ হাজার ২৮৭ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঁচ কোটি আট লাখ ৯৬ হাজার ২০৮ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ৮২ টাকা নিট মুনাফা করেছে।

পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৭.২৮ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭.৭২ টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮.২৫, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫.১৫ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭.১০ টাকা। কিন্তু গত নয় মাসে (জুলাই২০- মার্চ২১) কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ০.৪৪ টাকা।

এদিকে, গত ১০ আগস্ট পেপার প্রসেসিংসহ নয় কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হয়েছে কি না তা খুঁজতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, জিবিবি পাওয়ার, এমারেল্ড অয়েল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড মিল, ঢাকা ডায়িং, ফুওয়াং সিরামিক ও বিকন ফার্মা।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, সম্প্রতি নয়টি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। শেয়ারদর কেন বেড়েছে, কারা এই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত তা খতিয়ে দেখতে একটি চার সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএসইসির পরিচালক শেখ মাহবুব উর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিএসইসির সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) অ্যাপ্লিকেশন সাপোর্ট বিভাগের প্রধান মইনুল হক। কমিটিতে আগামী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে, হঠাৎ করে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) 
বাড়ল কেন তা খতিয়ে দেখা হবে। কোম্পানিগুলোর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করেছে কি-না তাও দেখা হবে। এছাড়াও কোম্পানির কর্মকর্তা এবং উদ্যোক্তাদের যোগসাজশ রয়েছে কি-না তা খুঁজে বের করা হবে।

এদিকে, ১৩ জুন মূল মার্কেটে ফেরা এই কোম্পানির তখন শেয়ারদর ছিল ৫৫ টাকা। কিন্তু কারসাজির মাধ্যমে সেই শেয়ারদর রবিবার উঠে দাঁড়িয়েছে ২০৯.৫ টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসে শেয়ারদর বেড়েছে ১৫৪.৫ টাকা ২৮১ শতাংশ। কোনো কারণ ছাড়াই মনোস্পুল পেপারের শেয়ারদর বাড়ছে বলেই মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

তাদের ভাষ্য, মনোস্পুলের শেয়ারদর এভাবে হু হু করে পেছনে কারসাজি থাকতে পারে। দর কেন টানা বৃদ্ধিতে রয়েছে তা খুঁজে বের না করলে শেয়ারদর আরও বাড়বে। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার ১৯৮৯ সালে তালিকাভুক্ত হলেও ১৯৯৬ সালে ১:৫ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। এরপর ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ বোনাস দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। সম্প্রতি ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে আসার জন্য ২০২০ সালে লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটি। এসময় তারা ৯ শতাংশ নগদ ও ৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার বছরের পর বছর মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মনোস্পুল পেপারের নিট মুনাফা ছিল তিন কোটি আট লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল তিন কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ২৬১টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৬ টাকা; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ২৯৭ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৭৬২ টাকা নিট মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।

প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ওটিসি মার্কেটে থাকাকালীন ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০.১১ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২.৬৭ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮.৮০, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২.১৪ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫.৫৬ টাকা। কোম্পানিটির জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ০.১০ টাকা এবং গত ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ০.২৮ টাকা।

(ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/আরএ/জেবি)