বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে খাদ্যের বড় প্রকল্পে পরামর্শক কালোতালিকার ‘মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স’ !

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:০০ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:৪৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের আটটি স্থানে নির্মিত হতে যাচ্ছে স্টিল সাইলো। যা আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পের আওতায় চলমান আছে। সম্প্রতি এই প্রকল্পের তদারকির কাজে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স প্ল্যানারস অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেড কাজ পেতে যাচ্ছে। যারা কাজের নিম্নমান এবং অনিয়মের অভিযোগে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প হতে অপসারিত ও কালোতালিকাভুক্ত  হয়েছে । প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে স্থাপনা ভেঙে অপচয় করতে হয়েছে সরকারি অর্থেরও। কিন্তু, বিস্ময়কর হলেও সত্য অভিযুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি আবারও নিয়োগ পেতে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বড় প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে।

 

এই প্রকল্পের অধীনে চাল ও গম সংরক্ষণে স্টিল সাইলো ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান  হিসেবে কাজ করছিল ফ্রান্সের ‘জেরিকো ফ্রান্স এসএএস’ । এ বছরের ৩১ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রকল্পের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।  সে কারণে নতুন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য গত বছরের  ১৪ জুলাই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

 

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে যেসব আবেদন জমা পড়েছে সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় আনা হয় । এরা হচ্ছে- ‘জেরিকো ফ্রান্স এসএএস’, যৌথভাবে ‘জেভি অব ন্যাশনাল অফিস ফর ইঞ্জিয়ারিং অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন (ইউক্রেন)’ ও বাংলাদেশের ‘মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স প্লানারস অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেডৎ’ এবং যৌথ ভাবে ‘মানিশ অ্যান্ড এসোসিয়েটস (ভারত)’ ও ‘ই সি বি এল বাংলাদেশ’ । টেকনিক্যাল ও ফাইনান্সিয়াল প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাইয়ের পর জেভি অব ন্যাশনাল অফিস ফর ইঞ্জিয়ারিং অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন (ইউক্রেন) ও বাংলাদেশের মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স প্ল্যানারস অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেডকে তালিকার শীর্ষে রাখা হয়।

 

একাধিক সূত্রে জানা যায়, বিতর্কিত মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সকে এমএফএসপির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি অভিযোগ পৌঁছে গেছে দাতাগোষ্ঠী বিশ্বব্যাংকের কাছে।

জানা যায়, খুলনায় নতুন নির্মিত রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ছাদ নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স । তাদের তৈরি নকশায় ও তদারকিতে নির্মিত ছাদে ৩১৪ ফিট লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছিল। পরে ছাদটি ভেঙে বুয়েটের নকশায় ফের নির্মাণ করা হয় । প্লাটফর্মের ছাদ তৈরির নকশায় ত্রুটি ও তত্ত্বাবধানে অবহেলার অভিযোগ সহ নিয়োগের শর্ত না মানা এবং অনিয়মের কারণে মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স প্ল্যানারস অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। পরে কালো তালিকাভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে পিটিশন করে মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স। কালো তালিকাভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থগিতাদেশ জারি করে। বর্তমানে বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

অভিযোগ আছে আরও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) সঙ্গে  গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীর উপর ১৪৯০ মিটার পিসি গার্ডার ব্রিজ তৈরির বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারসের। কিন্তু পরবর্তীতে, চুক্তিমোতাবেক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের নিয়োগ না দেয়া, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং অন্যান্য শর্ত না মানায় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করা হয়। এছাড়াও, একই অভিযোগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প থেকে অব্যহতি দেওয়া হয় মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সকে। আরও সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০০২-২০০৩ সালে খাদ্য অধিদপ্তরের সেভেন সিএসডি ও ওয়ান এলএসডির পুনর্নির্মাণের সময় মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারসের বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যক্রম, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে ।

 

অভিযোগ রয়েছে, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেলেও মডার্ন কোনো পরামর্শকের ভূমিকা পালন করে না, বরং প্রকল্পের ঠিকাদারদের ওপর সব দায় চাপিয়ে দেয়। নিজেরা কোনো তত্ত্বাবধানের কাজ করে না। এ বিষয়ে দায়সারা আচরণ করে প্রতিষ্ঠানটি ।  

 

এই অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশয় প্রকাশ করে যে, যেখানে রাস্তা, স্টেশন বা ব্রিজের মত সাধারণ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টে মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স  সঠিক ভাবে প্রকল্প তদারকিতে ব্যার্থ হয় হয়েছিল, সেখানে  এমএফএসপির মত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্পে সাইলো নির্মাণের জন্য পরামর্শক হিসাবে তাদের নিয়োগের যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাই, এই নিয়োগের চলমান প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার জন্য অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগকে (ই আর ডি) অনুরোধ জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মডার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স প্ল্যানারস অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ. সোবহান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘খুলনা রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ছাদের কাজটিকে কেন্দ্র করে যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে উচ্চ আদালতে বিচার চলছে। তারা যে আমাকে কালোতালিকাভুক্ত করেছে তার বিরুদ্ধে আমি আদালতে আবেদন করেছি।’ কাজে ঢিলেমি করায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্প থেকে কাজ শেষ হওয়ার আগে তার প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাজে ঢিলেমি হয়নি। চুক্তিতে বলা আছে কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় চুক্তি বাতিল করতে পারে, সেজন্য তারা তা করেছে। কী জন্যে করেছে আমার জানা নেই।’

 

এ ব্যাপারে এমএফসিপির প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এখনো মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। বিষয়টি চূড়ান্ত হলে সবাই জানতে পারবে।’  

 

(ঢাকাটাইমস/২১সেপ্টেম্বর/এইচএফ)