সারদা থেকে মংলা

মোহাইমিনুল ইসলাম
| আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৪০ | প্রকাশিত : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:২০

গ্রামাঞ্চলে শিশুকালে দেখতাম ছোট ছোট খাল থেকে গুইসাপ আর ঝোপঝাড় হতে বনবিড়াল বের হয়ে লোকালয়ে চলে আসত। যে এলাকায় এই খালগুলো হলো সুন্দরবনের খাল আর বন হলো সুন্দরবনের অংশ। সেখানকার সংগ্রামী মানুষের বাড়ির আঙিনায় গুইসাপের বদলে কুমির আর বন বিড়ালের বদলে বাঘ উঠে আসবে-এটাই স্বাভাবিক! আমরা ছাগলের মাংস খেয়ে মহাখুশি আর এরা নাকি হরিণের মাংস খেয়ে বাঘকে চ্যালেঞ্জ জানায়!

সুন্দরবন এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব পড়েছে শুনে শুরুতে এসব বিষয় মাথায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। দেশে একদিনে ১৬০ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বাগেরহাটে নির্বাচনী দায়িত্ব পড়েছিল। বাগেরহাটের ফোকাল পয়েন্ট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসন ও অপরাধ আসাদ স্যার বললেন, "সবচেয়ে ঠান্ডা এলাকা মংলায় তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি।" স্যারের বিষয়ে দুটি বাক্যে বলতে হলে বলা যায়, স্যার নিজের গাড়ি, নিজের বন্ধুক নিজে চালান, নিজের যা মাছ মাংস লাগে তাও শিকার করে খাবার নেশা আছে, প্রায় সব খেলাধুলায় পদচারণা আছে আর আর সব রকমের মন খারাপ ভালো করতে পারদর্শী এমন হাস্যরস বোধ আছে।

এমন এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে ঠান্ডা নয় বরং থ্রিলিং কোনো জায়গার কথা শোনার কথা; অথচ স্যার নিজেই বললেন ঠান্ডা এলাকা! যা হোক, পুলিশ লাইনসে এসপি স্যারের সেন্ট্রাল ব্রিফিং শেষে সবাই মিলে আলাদা ভাবে স্যারের কাছে বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ করলাম। স্যারের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা সত্যিই মনে রাখার মতো।

নির্বাচনের আগের বিকেল; শুনে এসেছি নির্বাচনী পরিবেশ ঠান্ডা; গিয়ে দেখি আবহাওয়া ও ঠান্ডা, সারাদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সুন্দরবন সংলগ্ন হাওয়া গায়ে লাগলে ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। এরই মধ্যে নির্বাচনের প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে থানায় অফিসারদের নিয়ে বসে কেন্দ্রগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রবণতা বিশ্লেষণ শুরু হলো। জানলাম তেমন কোনো ঝুকি নেই, তাই উপজেলা পরিষদে বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য অফিসারদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে রথ দেখা আর কলা বেঁচার অংশ হিসেবে এ এলাকার সর্ব দক্ষিণের জনবসতি 'চিলা' এর কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন করে আসব ভাবলাম। বাংলাদেশের বড় খাদ্য গুদাম (সাইলো) এই চিলা ইউনিয়নে; সেটিসহ এই সফরে সুন্দরবন ইউনিয়নের কিছু দূর্গম ও ঝুকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রেও যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। সফরসঙ্গী হিসেবে সফরের প্লানার প্রিয় সহকর্মী সার্কেল এ এস পি আসিফ ও কৃষি অফিসার, হলের কাছের ছোট ভাই রোকনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত হলো।

গাড়িতে উঠেই জানলাম সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ যে কেন্দ্রটি আছে সেখানে মারামারি- ধাওয়া পালটা হচ্ছে। আগে থেকেই মাথায় আছে যে এই ইউনিয়ন হলো আদর্শ ইউনিয়ন, এই ইউনিয়নের মানুষ নাকি মারামারি কি জিনিস তা-ই জানে না! তাই হালকা মুডের সিদ্ধান্ত হলো যে ঐ রাস্তা ঘুরে ৫ মিনিট পরিস্থিতি দেখে একটু প্রশমিত করে যাওয়া যাক। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যার দিকে সেই মারামারির স্থলে পৌঁছানোর আগে আগেই দেখলাম আহত কিছু লোকজন ভ্যানে করে বিপরীত দিকে হাসপাতালের পথে আমাদের অতিক্রম করলো। এটা দেখে এই ভদ্র এলাকার ওপর একটু মন খারাপ হলো। দুজন এস আই ভ্যান থামিয়ে আহতদের ইনজুরি গুলো দেখে নিশ্চিত করলো মারামারিতে এরা এত অদক্ষ নয়।

ভোটের আগের দিনেই শান্ত এলাকার মেম্বারে মেম্বারে এসব সংঘর্ষ রীতিমতো অশনিসংকেত । ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল মার খাওয়া প্রার্থীর লোকজন লাঠি সোটা নিয়ে তৈরি হচ্ছেন; ও পাশেও তেড়ে আসা দল। এবার আমাদেরও বাধ্য হয়ে কিঞ্চিত অভদ্র হয়ে মারামারির প্রস্তুতি ভেংগে দিয়ে ধাবমান বীরদের ধাওয়া দিয়ে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হলো। এর মধ্যে হাসপাতাল হতে কল দিয়ে জানানো হলো এই মারামারি থেকে আহতদের মধ্যে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে একজন মারা গিয়েছেন।

মূহুর্তে ছড়িয়ে গেল নির্বাচনী সহিংসতায় একজনের মৃত্যু। এরপর রোবটের মতো হাসপাতালে ছুটে যাওয়া, লাশ দেখা, সুরতহাল, পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ ও কাগজপত্র প্রস্ততি, প্রত্যক্ষ সাক্ষী খোঁজা ও কথা বলা; প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধানের চেষ্টা,আসামী খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করা- এসব নিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে রাত ৩ টা বেজে গেছে তা কারো মাথায় নেই; সেই হালকা মুড আর দৃশ্য উপভোগ করার বদলে কখন যে নিজের অজান্তেই ভারিক্কি মুডে গিয়ে অন্য রকম এক সিনেমাটিক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে সবাই ভুলে গিয়েছি। রাত চারটায় ঘুমোতে গিয়ে আবার সকাল সাড়ে সাতটায় কর্মবন্টন অনুযায়ী সবাই যার যার কর্মে হাজির! নির্বাচনের দিনের সংবাদ সংযোগেও যথারীতি থাকলো -

এখানে ওখানে মারামারি, ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধাদান, ভোট কেনাবেচা/প্রভাব বিস্তার হচ্ছে ইত্যাদি। এসব অনুযোগ অভিযোগের প্রেক্ষিতে এদিক ওদিক ফোর্স মোবিলাইজ করে বা নিজেরা ছুটাছুটি করে গিয়ে নির্বাচনের দিন যে কিভাবে শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে রাতে গড়িয়েছে ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েকটি কেন্দ্রে শেষ বিকেলে গিয়ে দেখি বিজয়ী আর বিজিত দলের মধ্যে সংঘর্ষ হবার উপক্রম! সেখানে কোন কোন পক্ষকে ডেকে আমরা সবাই মিলে শান্তনাও দিলাম। এই পরাজয় যে শেষ পরাজয় নয়- এই মর্মে একটা বয়ান ও দেয়া লাগলো!

দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভালো লেগেছে ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরে, খাল পাড় হয়ে টানা হেটে গিয়ে ঘেমে গিয়েছি, আবার নৌকায় নদী পাড়ের সময় বাতাসে জুড়িয়েছে শরীর। একমাত্র মোংলাতে মনে হয় সুন্দরবন নামেই একটি ইউনিয়ন আছে! এর এপাশ ওপাশ, খাল- সাঁকো পাড় হতে হয়েছে। চলেছি হেটে, গাড়িতে বা বাইকে; বলেছি মুখে ইশারায় বা মাইকে। কোথাও কোথাও সুন্দরবনের দিকে স্রোতস্বিনী খাড়ির ওপর করমজলের মত কাঠের ব্রিজেও হেটেছি।

চারদিকে গোলপাতা, কেওড়া আর নোনাপানির ঘের-বেশ মোহনীয় লেগেছে। এদের সংগ্রামী জীবন কাছে থেকে অনুভব করার একটা চার্ম আছে। একই সাথে এবার পুলিশের সংগ্রামী ডিউটি খুব কাছে থেকে সরাসরি টানা দেখে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এক একজন কয়েকদিন না ঘুমানো শরীর নিয়ে এলোপাথাড়ি পা ফেলছে-এটাও খেয়াল করলাম। অন্যরা কে কি করছে, কি করবে সেসব ভাবার সময় নেই তাদের; কাজ যা সামনে চলে আসছে নির্দ্বিধায় করে চলছে যেন। মুখে শুধু একটাই কথা, "ইয়েস স্যার।" ওসিকে মনে হলো একজন রোবট; তার দুইটা ফোন আর ওয়াকি টকিতে কল আসার প্রতিযোগিতা চলছিল সারাদিন। গ্রামের সাধারণ ছেলে, ছোট নেতা

লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :